ভারতীয় জাদুঘর
ভারতীয় জাদুঘর
কলমে : সুতপা দত্ত
জাদুঘর বা সংগ্রহালয় বলতে বোঝায় এমন একটি ভবন প্রতিষ্ঠান যেখানে পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহের সংগ্রহ সংরক্ষিত থাকে। জাদুঘরে বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন বস্তু সমূহ সংগ্রহ করে সংরক্ষিত করা হয়। বিশ্বের অধিকাংশ বড় জাদুঘরই প্রধান প্রধান শহর গুলিতে অবস্থিত।
অতীতকালে জাদুঘর গুলি গড়ে উঠতো ধনী ব্যাক্তিদের ব্যাক্তিগত বা পারিবারিক উদ্যোগে বা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে। এইসব জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকতো শিল্পকর্ম,দুষ্প্রাপ্য ও আশ্চর্যজনক প্রাকৃতিক বস্তু বা পুরা বস্তু।
ভারতীয় জাদুঘর হল ভারতের অন্যান্য জাদুঘর গুলির মধ্যে বৃহত্তম জাদুঘর, যা কলকাতায় অবস্থিত। ১৮১৪ সালে কলকাতা যখন বৃটিশ ভারতের রাজধানী তখন এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে। এই সোসাইটি ,অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্তিম ভাগে , উইলিয়াম জোন্স প্রাচ্য সম্বন্ধে গবেষণার উদ্দেশ্যে তৈরি করবেন বলে উদ্যোগী হন। ১৭৮৪ সালে ১৫ই জানুয়ারী তিরিশ জন ইউরোপীয় বিদগ্ধ ব্যাক্তি কলকাতা শহরের পুরাতন সুপ্রিম কোর্ট ভবনের এক সভায় মিলিত হন। এই সভাতেই স্যার রবার্ট চেম্বার্সের সভাপতিত্বে , জোন্সের পরিকল্পনা মত ‘দ্য এশিয়াটিক সোসাইটির’ প্রতিষ্ঠা হয়। এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল , এশিয়ার ভৌগলিক সীমার মধ্যে মানুষ ও প্রকৃতি দ্বারা সৃষ্ট সমস্ত বিষয় সম্বন্ধে অনুসন্ধান ও অধ্যয়ন করা।
১৭৯৬ সালে সোসাইটির সদস্য রা মানুষের তৈরি বস্তু ও প্রাকৃতিক সামগ্রী নিয়ে একটি জাদুঘর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৮০৮ সালে জাদুঘর তৈরির কাজ শুরু হয়। এই বছরই ভারত সরকার সোসাইটিকে চৌরঙ্গী অঞ্চলে জাদুঘর তৈরির জন্য জমি দেয়। প্রায় এই সময়েই একটি অন্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। শ্রীরামপুর যুদ্ধের সময় বন্দি করা হয়েছিল ডাচ উদ্ভিদবিদ ড. নাথানিয়েল ওয়ালিচ কে।অবরুদ্ধ থাকার সময় তিনি স্বপ্ন দেখেন একটি সংগ্রহালয় বা জাদুঘরের। যখন তিনি পাড়িদিয়েছিলেন ভিনদেশে সেই সময় তার দেশ ডেনমার্কের প্রথম জাদুঘর ন্যাশনালম্যুজিত এর পথ চলা শুরু হয়ে গেছে। পরে তার মুক্তির পর তিনি বিশেষ চেষ্টা করেন এবং ১৮১৪ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি,কলকাতায় জাদুঘর স্থাপনের সমর্থনে একটি চিঠি লেখেন। তিনি তার সংগ্রহের কিছু সামগ্রী দান ও করতে চান এবং জানান তিনি জাদুঘরের সেবা করবেন অবৈতনিক কিউরেটর হিসেবে। সোসাইটি তার এই প্রস্তাব গ্রহণ করে। ড.ওয়ালিচ সেই সময়েছিলেন সোসাইটির প্রাচ্য জাদুঘরের সুপারিন্টেনডেন্ট।তাকেই ভারতীয় জাদুঘরের প্রথম সাম্মানিক পরিচালক অর্থাৎ কিউরেটর নিযুক্ত করা হয় |১৮১৪ সালের ১লা জুন তিনি কার্যভার গ্রহন করেন।জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর থেকে তার উৎসাহেই জাদুঘরের আকার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সেই সময় সংগ্রাহকরা মূলত ছিলেন ইউরোপীয়।
জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ১৮ বছর বাদে ইউরোপীয় ব্যূহ ভেদ করে প্রবেশ করলেন ভারতীয়রা। ১৮৩২ সালের এক তালিকায় মোট ৪৯ জন দাতার মধ্যে ৬ জন ভারতীয়ের নাম পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে শিরোমণি বাবু রামকমল সেন -কেশব চন্দ্র সেনের পিতামহ। এছাড়া ছিলেন মহারাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুর,শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব, মথুরানাথ মল্লিক এবং শিবচন্দ্র দাস -এই পাচ বঙ্গ সন্তান এবং সারঘানার বেগম সমরু। বেগম সাহেবা সেদিন দান করেছিলেন সুলতানি আমলের কয়েকটি রৌপ্য এবং তাম্রমুদ্রা। মহারাজা কালীকৃষ্ণ দিয়েছিলেন রান্নার থালা বাসন, পান-দান এবং একটি কেটলির মডেল। রাধাকান্ত দেব দিলেন একটি বিচিত্র পারাবত –‘এ ইয়ং পিজিয়ন উইথ টু হেডস’। মথুরা নাথের দান একটি মালয়ী ছোরা আর শিবচন্দ্র দিলেন এক গোর্খা ঝান্ডা,একটি লৌহ দন্ড তার সঙ্গে অনেক রিং বাধা। আর রামকমল বাবু দিলেন গ্রামীণ বঙ্গ সংস্কৃতির উপকরণ গীতবাদ্যের ৪১ টি সরঞ্জাম, চড়ক পুজোর নানা উপকরণ, যার সংখ্যা ১৬ একটি মাদার গাছের পতাকা এবং বিশ্বাস করুন,একটি শুটকি মাছ-‘এ ড্রায়েড ফিস!
সম্পূর্ণ নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে জাদুঘরের সেই আদি পর্বে এই লোককৃষ্টি সংগ্রহ করা হয়েছিল। রামকমলের হাত ধরে চড়ক সেদিন ঢুকলো চৌরঙ্গীর জাদুঘর। অশেষ গুণসম্পন্ন এই মানুষ টি তখন এশিয়াটিক সোসাইটির নেটিভ সেক্রেটারি এবং কালেক্টর, দুটি পদ সামলাচ্ছেন। প্রথম পদে যোগ দিয়েছিলেন ১৮৩২ এর ডিসেম্বর এ। অন্য এক বাঙালি হেরম্বনাথ ঠাকুর তখন সহ গ্রন্থাগারিক।
ড. ওয়ালিচ কিউরেটর পদত্যাগ করার পর ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত সোসাইটি মাসিক ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেতনে কিউরেটর রাখা শুরু করে। পরবর্তীকালে সরকার থেকে এই বেতন দেওয়া হত। জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ২৫০ টাকা অনুদান দেওয়া শুরু হয়। ১৮৪০ সালে সরকার জাদুঘরের ভূতাত্ত্বিক ও খনিজ সংগ্রহ বিভাগ চালুর ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ২৫০ টাকা অনুদান দিতে শুরু করে। এই প্রসঙ্গেই জানিয়ে রাখা যায় নাথানিয়েল যেমন প্রথম ইউরোপীয় কিউরেটর তেমনই তার ৫০ বছর পর ১৮৬৪ সালে প্রথম বাঙালি কিউরেটর হয়েছিলেন পূর্ণচন্দ্র বসাক। যদিও অস্থায়ীভাবে। সে বছর ১,০৪,৬৪০ জন দর্শক এসেছিলেন জাদুঘরে। দৈনিক ৩৯৫ জন।
১৮৬৬ সালের জানুয়ারী মাসে আর একজন স্বনামধন্য ‘বসাক’ জাদুঘরের প্রসিডিংসে স্থান পেলেন দাতা হিসেবে। তার নাম বাবু গৌরদাস বসাক – মাইকেল মধুসূদন দত্তের আবাল্য সুহৃদ,’মাই ডিয়ার গৌর’।তিনি এনে দিলেন যশোরের আকাশ থেকে পড়া একটি উল্কা পিন্ড। সেটী মাটিতে পড়েছিল ১৮৬৫ সালের মে মাসে। এইভাবে সেই সময়ের বঙ্গসমাজের বহু বিশিষ্ট ব্যাক্তির উৎসাহ এবং উল্লেখযোগ্য উপহার দান হিসেবে দেওয়ায় তিলে তিলে গড়ে উঠেছিল বর্তমান ভারতের বৃহত্তম জাদুঘর।
বর্তমানের ভিক্টোরিয়ান সৌধটির ভিত্তিস্থাপন করা হয় ১৮৬৭ সালে এবং ১৮৭৫ সালে এর নির্মান কাজ সম্পন্ন হয়। এর স্থপতি ছিলেন ডব্লিউ. এল. গ্র্যানভিল।চৌরঙ্গী রোডের উপর সবুজ ময়দানের পাশে এ প্রাসাদে স্থাপিত জাদুঘর টি ১৮৭৮ সালে জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
বর্তমানে এর ছয়টি বিভাগ রয়েছে। শিল্পকলা,পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, প্রাণীতত্ত্ব ও অর্থনৈতিক উদ্ভিজ্জ। ভারতীয় সংবিধানের সপ্তম তফসিলে এই প্রতিষ্ঠান কে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন জাদুঘর।এখন এটি ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের পরিচালনাধীন।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে প্রাক ও আদি ঐতিহাসিক নিদর্শনের পাশাপাশি অন্যান্য বহুযুগের নিদর্শনের সংগ্রহ ও রয়েছে। একটী বিশেষ গ্যালারীতে রয়েছে মিশরীয় প্রাচীন নিদর্শনের একটি সংগ্রহ যার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে একটি মমি। এছাড়াও বিভিন্ন শিলালিপি ,পান্ডুলিপি,বিভিন্ন সময়ের মুদ্রাসসমূহ কয়েকটি গ্যালারীতে প্রদর্শিত হচ্ছে।
শিল্পকলা শাখাটিতে ভারতীয় চিত্রকলা,শিল্পকলা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের শিল্পসামগ্রীও প্রদর্শিত হচ্ছে। নৃবিজ্ঞান শাখায় প্রত্ন-নৃতত্ত্ব ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের বিভাগের সাথেই রয়েছে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে সজ্জিত একটি গ্যালারী। জুওলোজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, জিওলোজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এবং বোটানিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া দ্বারা পরিচালিত বিজ্ঞগান শাখার অনেকগুলি গ্যালারী আছে। প্রাণীবিদ্যার গ্যালারীতে কীটপতঙ্গ, মাছ, উভচর প্রাণী, সরীসৃপ প্রাণী, পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণী প্রদর্শিত হচ্ছে।
অর্থকরী উদ্ভিজ্জ শাখায় ভেষজ গাছ গাছড়া, উদ্ভিজ্জ তন্তু,রঞ্জক উদ্ভিদ, আঠা ও রেসিন ইত্যাদির সংগ্রহ রয়েছে। ভূতত্ত্ব বিভাগের সংগ্রহ পাচভাগে বিভক্ত,সিওয়ালিক জীবাশ্ম,ভূপৃষ্ঠ ও উল্কাপিন্ড,প্রস্তর ও খনিজ,অমেরুদন্ডী ও মেরুদন্ডী প্রাণীর জীবাশ্ম।
সময়সারণী বলে, দুশো বছর ধরে এক অনবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতায় এই ইতিহাস বাড়ি ছায়া ফেলেছে নগরদর্পণে। সমাজ নামক এক বিশাল জলাধারে পড়েছে তার প্রতিবিম্ব। কুবাতাস, সুবাতাসে সেই জলে কম্পন লাগলে প্রাসাদপুরীটির ছায়াতেও ঢেউ উঠেছে পড়েছে।ধ্বনিকে প্রতিধ্বনি সাড়া দিয়েছে অন্তরে বাহিরে। দুই শতকের বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে রঙ্গ দেখাচ্ছে জাদুঘর।
তথ্যসূত্রঃ কলিকাতার পুরাকথা, ভারতীয় জাদুঘর
কলমেঃ সুতপা দত্ত
খুব ভালো লাগলো ম্যাডাম আপনার লেখাটি পড়ে, অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা |ভারতীয় মিউজিয়াম সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য পেলাম ও সমৃদ্ধ হলাম |অনেক ধন্যবাদ আপনাকে|
ReplyDeleteধন্যবাদ আপনাকে।
DeleteBeautifully written. Proud of you ❤
ReplyDeleteThank you, swagata. My girl😍
ReplyDeleteCovered a difficult topic with ease. Enriched my knowledge. Kudos to you.
ReplyDeleteThank you.😃
ReplyDeleteDarun hoye6e kamma ❣❣
ReplyDeletethank you...mimi😍😘
ReplyDeleteতথ্য সমৃদ্ধ এবং এক নিশ্বাসে পড়ার মত লেখা।
ReplyDeleteতথ্য সমৃদ্ধ এবং এক নিশ্বাসে পড়ার মত লেখা।
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDelete