'ভিক্টোরিয়া-মেমোরিয়াল' - ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের এক গৌরবজ্জ্বল সৃষ্টি

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল - ব্রিটিশ  ঔপনিবেশিক শাসনের এক গৌরবজ্জ্বল সৃষ্টি

কলমে : সঞ্চারী ভট্টাচার্য্য

স্বাধীনোত্তর পূর্ব যুগ পর্যন্ত কলকাতাই ছিলো ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী |শিক্ষার প্রসার ও পশ্চিমাকরণের মধ্য দিয়ে বাংলায় 'রেনেসাঁ'র পর্ব শুরু হয়। বহু সামাজিক সংস্কার আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল এই সময় এবং বৌদ্ধিক জনগোষ্ঠী এই পর্ব থেকেই স্বাধীনতার অর্থ বুঝতে শুরু করেন |তখন এই শহরটি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সমস্ত উত্তেজনার ফলে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিতকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত  হয়। স্থানান্তরিত হওয়ার পরেও কলকাতা বাণিজ্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে নিজের ভূমিকা বহাল রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল,কলকাতা 

লর্ড ওয়েলেসলি কর্তৃক কলকাতার আর্কিটেকচারাল সাজসজ্জার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল |ব্রিটিশ শাসনের প্রধান রূপকার হিসাবে তখন ইংল্যান্ডে রাজশাসন পরিচালনার নেতৃত্বাধীন কর্তৃত্ব ছিলেন মহারানী ভিক্টরিয়া, যিনি 'কুইন অফ ইংল্যান্ড' - নামেও সুবিদিত ছিলেন |ঔপনিবেশিক শাসন পরিকাঠামো নিয়ন্ত্রণে তিঁনিই শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন |ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসাবে ক্যালকাটা মনোনিত হবার পর তা সরাসরি রানী ভিক্টরিয়ার নেতৃত্বাধীনে আসে |কলকাতার যাবতীয় সংস্কার তাঁরই অনুগ্রহে সাধিত হয়েছিল |তিনি নাকি তাঁর শাসনকালে কোনদিনই কলকাতা শহরটি পরিদর্শনের জন্য আসেননি |ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময় লর্ড মাউন্টব্যটেন কর্তৃক মহারানীর ঘোষণাপত্র জারি করা হয়েছিল, যাতে লেখা ছিলো 1947 সালের 15ই আগস্ট থেকে সমগ্র ভারতবর্ষ ব্রিটিশ কর্তৃত্বের থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত প্রতিপন্ন হলো |

 ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল,কলকাতা

এরপর আর ইংল্যান্ডের সরকার শাসনতান্ত্রিক কোনো কর্তৃত্ব ভারতের উপরে ফলাবেন না |রানী ভিক্টোরিয়া কোনদিন কলকাতায় না এলেও ভারতের রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তকরণের পূর্বে তাঁর উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে একটি সম্মান সৌধ নির্মাণ করা হয়েছিল |

 ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল,কলকাতা

ঔপনিবেশিক শাসন চলাকালীন কলকাতা শহরটি ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার দরুন ঐ শহরেই রানী ভিক্টোরিয়ার  উদ্দেশ্যে একটি বিশাল আভিজাত্যের নিদর্শন হিসাবে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছিল যা 'ভিক্টোরিয়া-মেমোরিয়াল' নামে সুপরিচিত |

 ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল,কলকাতা

কলকাতার বয়েস ভারতের অন্যান্য বিখ্যাত শহরের তুলনায় কিছুই না। কিন্তু আঠেরো-উনিশ শতক জুড়ে ব্রিটিশ ভারতের এই রাজধানী ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশদের কাছে ‘লিটল লন্ডন’ বলেই পরিচিত ছিল। সেটাই হয়তো স্বাভাবিক, কারণ মুঘল ঐতিহ্যের দিল্লি বা নবাবি ঐতিহ্যের লখনউ-এর মতো শহরকে একাত্ম করে নেওয়া ব্রিটিশদের পক্ষে কখনও সম্ভব ছিল না। কলকাতা সাবর্ণ রায়চৌধুরী জমিদারদের অধীন গণ্ডগ্রাম ছিল, ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল,তাকে আস্তে আস্তে ব্রিটিশরা অনেকটা নিজেদের ছাঁচে তৈরি করে নিল।

 ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল,কলকাতা

পুরোপুরি অবশ্যই পারেনি, জয়পুর বা আগরতলার মতো পুরোপুরি পূর্ব-পরিকল্পিত শহর না-হলে তা বোধহয় সম্ভবও নয়। তবু ফিভার হসপিটাল কমিটি থেকে লটারি কমিটি, একের পর এক উন্নয়নের উদ্যোগে শহরের চেহারা, এমনকী নেটিভ টাউনের চেহারাও অনেকটাই বদলে গেছিল। এই অবস্থায়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গৌরবোজ্জ্বল দিনে, জানুয়ারি 1901-এ প্রয়াত হলেন সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া। বড়লাট তখন কার্জন, ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিরক্ষায় তিনি যে স্মারক তৈরির প্রস্তাব করলেন তা যে কলকাতাতেই হবে এতে দ্বিমতের বিশেষ অবকাশ ছিল না। কার্জনের পক্ষে অবশ্য অনুমান করা সম্ভব ছিল না, আর এক দশকের মধ্যে কলকাতা রাজধানীর গৌরব হারাবে| ঠিক হল, ময়দানের দক্ষিণ প্রান্তে প্রেসিডেন্সি জেলের জায়গায় তৈরি হবে স্মৃতিসৌধ। সরিয়ে নেওয়া হল প্রেসিডেন্সি জেল। কেমন স্মৃতিসৌধ চেয়েছিলেন কার্জন? তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, এর নকশা ভারতীয় স্থাপত্যের অনুসারী হবে না, ধ্রুপদী বা রেনেশাঁস শৈলীর ভবন হওয়া জরুরি। 

 ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল,কলকাতা

শুধু তা-ই নয়, সৌধটিকে স্থাপন করতে হবে চমৎকার উদ্যানের মধ্যে। অর্থাৎ মুখে যা-ই বলুন, কোথাও কি তাঁর মনের গোপনে তাজমহলের মতো কালাতিক্রমী স্মারক-স্থাপত্যের অনুরণন ছিল না? সে যাই হোক, শেষ পর্যন্ত নকশা তৈরি করলেন রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস-এর প্রেসিডেন্ট, বিখ্যাত স্থপতি উইলিয়াম এমার্সন। এমার্সন তখন বৃদ্ধ, চল্লিশ বছর আগে ভারতে এসে তিনি মুম্বইয়ের ক্রফোর্ড মার্কেট, ইলাহাবাদের অল সেন্টস ক্যাথিড্রাল, এবং ভারতে ইন্দো-ইসলামি শৈলীর অন্যতম প্রথম সৌধ এলাহাবাদের মিওর কলেজ (১৮৭৩), পরে গুজরাতের ভাওনগরে প্রাসাদ ইত্যাদি নির্মাণ করে খ্যাতি অর্জন করেন।

 ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল,কলকাতা

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ক্ষেত্রে এমার্সনকে সাহায্য করেন ভিনসেন্ট এশ, যিনি ১৯০৩-এ দিল্লি দরবারের অস্থায়ী প্রদর্শনী কক্ষ তৈরি করে কার্জনের আস্থা অর্জন করেন, আর কলকাতায় ভিক্টোরিয়ার আগে বেঙ্গল ক্লাব, গার্ডেনরিচে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের সদর দফতর তৈরি করে যথেষ্ট পরিচিত হয়ে ওঠেন। পরে তিনি হায়দরাবাদের নিজামের অধীনে বহু গুরুত্বপূর্ণ ভবনের পরিকল্পনা করেছিলেন।

মহারানী ভিক্টোরিয়ার ছেলেবেলার ছবি, মেমোরিয়াল,কলকাতা

ভারতে রানী ভিক্টোরিয়ার পঁচিশ  বছরের শাসনকালের স্মরণে এটি 1906 থেকে 1921 সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। 1857 সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরে ব্রিটিশ সরকার সরাসরি দেশের নিয়ন্ত্রণের লাগাম সংগ্রহ করে এবং 1887 সালে ব্রিটিশ সংসদ ভিক্টোরিয়াকে ভারতের সম্রাজ্ঞী ঘোষণা করে।

মহারানী ভিক্টোরিয়া,ভিক্টোরিয়ামেমোরিয়াল,কলকাতা

1947 সালে স্বাধীনতা লাভের পর বিভিন্ন ইংরেজ প্রশাসকদের মূর্তি সরিয়ে সেই স্থানে ভারতীয় বিখ্যাত ব্যক্তিদের মূর্তি বসানোর কাজ শুরু হয়। সরিয়ে ফেলা সেই সব মূর্তির বেশিরভাগ স্থান পায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জেমস আউটরামের মূর্তি, যেটি পূর্বে পার্কস্ট্রীট ও চৌরঙ্গী ক্রসিং-এ শোভা পেত। 1958 সালে সেই জায়গায় স্থান পায় মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি। 

মহারানী ভিক্টোরিয়া, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

এই চমকপ্রদ কাঠামোতে বর্তমানে চার্লস ডি'য়লি, জোহান জোফনি, উইলিয়াম হ্যাজেস, উইলিয়াম সিম্পসন, টিলি কেটল, টমাস হিকি, বুল্টজার সলভিজনস, টমাসের মতো বিখ্যাত ইউরোপীয় শিল্পীদের তেল চিত্রকর্ম এবং জলের রঙের বিশাল সংগ্রহের মতো ব্রিটিশ ভারতের স্মৃতিসৌধের একটি জাদুঘর রয়েছে । এগুলি ছাড়াও, স্মৃতিসৌধে ড্যানিয়েলসের চিত্রকর্মগুলির বিশ্বের বৃহত্তম সংগ্রহ রয়েছে।

মহারানী ভিক্টোরিয়া, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

1906 সালের 4ঠা জানুয়ারি এই ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রিন্স অফ ওয়েলস হিসেবে ভারত সফরে আসা পরবর্তীকালের রাজা পঞ্চম জর্জ এবং 1921 সালের 28শে  ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রিন্স অফ ওয়েলস ও পরবর্তীকালের রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড।ভারতে ইউরোপীয় উপনিবেশ এবং সেই সাথে ব্রিটিশ শাসন ভারতের স্থাপত্যে এক গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।এই রীতির স্থাপত্যিক প্রকাশ দেখা যায় গির্জা, ব্যারাক, দুর্গ, আবাসিক ও প্রশাসনিক ভবন ইত্যাদিতে।

মহারানী ভিক্টোরিয়া, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

ব্রিটিশরা ভারতের স্থাপত্যশিল্পে নতুন কিছু কারিগরী শৈলীর সূচনা করে, যা ছিল সেই সময়ে ভারতীয়দের ব্যবহৃত পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভারতে ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতির শ্রেষ্ঠ নির্দশন। এটি স্বাধীন ভারতে আধুনিক স্থাপত্যরীতির পথ নির্দেশনা দিয়েছে।

লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস,ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট-এর প্রেসিডেন্ট স্যার উইলিয়ম এমারসন এই ভবনের পরিকল্পনা ও নকশা প্রস্ত্তত করেন। তবে সুপারিনটেন্ডেন্ট আর্কিটেক্ট হিসেবে এর নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধান করেন ভিনসেন্ট জে ইস্চ (Vincent J Esch)। তিনি ছিলেন বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। 1902 সালে এমারসন তাঁকে ভবনের মূল নকশার ওপর একটি স্কেচ দাঁড় করানোর দায়িত্ব দেন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয় কলকাতার মেসার্স মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি।

লর্ড কর্নওয়ালিস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

তবে মেমোরিয়াল নির্মাণের মূল কাজটি অত্যন্ত শ্লথ গতিতে অগ্রসর হতে থাকে। 1905 সালে কার্জন যখন ভারত ছেড়ে যান তখন এর কাজ ঠিক মতো শুরুই হতে পারেনি। এই শ্লথ গতির পেছনে কারণ হলো, কার্জনের পর যিনি ভারতে ভাইসরয়ের দায়িত্ব নিয়ে আসেন তিনি তাঁর পূর্বসূরির মতো মেমোরিয়ালের ব্যাপারে ততটা উৎসাহ দেখাননি; আর সেই সাথে ভবন নির্মাণে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও দীর্ঘসূত্রিতা চলে। পরিকল্পনার সাব-স্ট্রাকচার নির্মাণকাজ শুরু হয় 1904 সালে এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১
1906 সালে। আর ভবনের উপরি-কাঠামোর নির্মাণকাজ শুরু হয় আরও চার বছর পর 1910 সালে। ইতোমধ্যে ইস্চ নিজেকে কলকাতার শ্রেষ্ঠ স্থপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন। তখন তাঁকে সরকারিভাবে প্রকল্পের সুপারিনটেন্ডেন্ট আর্কিটেক্ট হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

 লর্ড ওয়েলেসলি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কলকাতা 

সাদা মার্বেল পাথরে এটি নির্মাণের জন্য লর্ড কার্জন প্রথম থেকেই জোরালো মত প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও এর গঠনপ্রক্রিয়ায় তাজমহলের প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়; যেমন, এর গম্বুজ, পার্শ্ববর্তী ক্লাস্টার্ড অষ্টভুজাকার গম্বুজ ছত্রী, সুউচ্চ জাঁকালো প্রবেশ তোরণ, উন্মুক্ত চত্বর, গম্বুজ আচ্ছাদিত কর্নার টাওয়ার ইত্যাদি। এমনকি এই দুই স্থাপত্যের উদ্দেশ্যের মধ্যেও সাদৃশ্য বিদ্যমান। তাজমহলের মতো এটিও এক সম্রাজ্ঞীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে  নির্মিত।

লর্ড ডালহৌসি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

64 একর জমির উপর লন, পুকুর, গুল্মরাজি ও লতাপাতায় ঘেরা বিশাল উন্মুক্ত অঙ্গনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সংস্থাপিত। কলকাতায় সম্ভবত এরূপ মনোরম ও উন্মুক্ত অঙ্গন দ্বিতীয়টি নেই। ভবনটির দৈর্ঘ্য 103.02 মিটার, প্রস্থ 69.49 মিটার এবং ‘অ্যাঞ্জেল অব ভিক্টরি’ মূর্তি পর্যন্ত এর উচ্চতা 56.08 মিটার। মূর্তিটি আরও 4.88 মিটার উঁচু। মেমোরিয়াল নির্মাণে ব্যয়িত মোট 1,05,00,000 টাকার সবটাই সংগৃহীত হয়েছে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও ভারতের দেশীয় রাজন্যবর্গের স্বেচ্ছাপ্রদত্ত অর্থ থেকে। বলা হয়ে থাকে যে, ভবনের সম্পূর্ণ নির্মাণ সামগ্রী বহনের জন্য প্রয়োজন ছিল একটি 27 কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রেনের।

ভবনের সর্বমোট ওজন হিসাব করা হয়েছে 80,300 টন এবং ব্যবহৃত  মার্বেলের মোট পরিমাপ 450.28 ঘন মিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবহণ খরচসহ মার্বেলের মোট মূল্য হিসাব করা হয়েছিল 25 লক্ষ টাকা। পরে অবশ্য ভারতীয় রেলবিভাগ পরিবহণ চার্জ দাবি না করলে মার্বেল বাবদ ব্যয় 2 লক্ষ টাকা কমে যায়।

মহারানী ভিক্টোরিয়া তাঁর পরিবারের সাথে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল 25টি গ্যালারির সমন্বয়ে গঠিত। ‘কুইন্স হল’টি আকর্ষণের মূল কেন্দ্র। এর সকল দেওয়ালে মহারানীর ঘোষণা লিপিবদ্ধ। তাঁর স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন ঘটনার অঙ্কিত চিত্র যেমন- তাঁর সিংহাসনারোহণ, তাঁর বিয়ে, তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারীর ব্যাপটিস্টকরণ, রাজপুত্রের বিবাহ, ফ্রগমোরে তাঁর বাসভবন ইত্যাদি দ্বারা গ্যালারি সজ্জিত। রানীর ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী, যেমন- শৈশবে ব্যবহৃত তাঁর পিয়ানো, উইন্ডসোর প্রাসাদে দৈনন্দিন চিঠি-পত্র লেখার জন্য ব্যবহৃত তাঁর টেবিল ও চেয়ার, ভারতীয় প্রজাদের উদ্দেশ্যে লেখা তাঁর শেষ চিঠি ইত্যাদি।

মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে আরও আছে বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষে আসা বিখ্যাত ব্রিটিশ নাগরিকদের প্রতিকৃতি;যেমন,মেলকে,কিপলিং, বিশপ হেবার,উইলিয়ম হিকি প্রমুখ। নিজ যোগ্যতায় ভারতীয় কিছু ব্যক্তিও এখানে স্থান করে নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কেশবচন্দ্র সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত,  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর পিতামহ  দ্বারকানাথ ঠাকুর। কিছু দলিল-পত্রও এখানে সংরক্ষিত আছে, এর মধ্যে রয়েছে নন্দকুমারের জালিয়াতি সম্পর্কিত দলিল যার জন্য তাঁকে অন্যায়ভাবে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হয়। এছাড়াও আছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্মৃতিবাহী বিভিন্ন নিদর্শনাদি, যেমন- রানী মেরী, পঞ্চম জর্জ ও অন্যান্যদের আবক্ষ মূর্তি, 1757 সালে পলাশীর যুদ্ধে দখলকৃত ফরাসি কামান ইত্যাদি।

মহারানী ভিক্টোরিয়া, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে প্রধান আকর্ষণীয় বস্তু হলো রানী ভিক্টোরিয়ার বিষণ্ণ বিশাল একটি মূর্তি। এর দুদিকে রয়েছে দুটি সুদৃশ্য জলাশয়। ভারত শাসনকারী অনেক শাসকই রোমান রীতির পরিচ্ছদাবৃত হয়ে এখানে প্রস্তর মূর্তিতে উপস্থাপিত, যেমন-  লর্ড ক্লাইভ,লর্ড  ওয়ারেন হেস্টিংস,লর্ড কর্নওয়ালিস,  লর্ড ওয়েলেসলী এবং লর্ড ডালহৌসী।

এমারসনের নকশা অন্যান্য আরও অনেকের সংযোজন দ্বারা আরও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়েছে। ভিনসেন্ট ইস্চের প্রধান অবদান হলো উদ্ভাবনী আদর্শের দ্বারা পরিবর্তিত ভিত্তি-নকশা। তবে তিনি প্রধান প্রবেশ তোরণের ভাস্কর্যসমূহ নির্মাণ, উত্তরাংশের অসাধারণ সেতুর নকশা প্রদান, ফটক ও বাগিচার মনোরম অলঙ্করণও তত্ত্বাবধান করেছিলেন। উত্তর পোর্চের উপরে ভাস্কর্যগুলি মাতৃত্ব, প্রজ্ঞা ও শিক্ষার প্রতীক হিসেবে নির্মিত। প্রধান গম্বুজকে ঘিরে থাকা ভাস্কর্যগুলি শিল্প, স্থাপত্য, ন্যায়বিচার, বদান্যতা ইত্যাদির জ্ঞাপক। প্রশস্ত ও মনোরম বাগান ভবনের সৌন্দর্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

মহারানী ভিক্টোরিয়া, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

গম্বুজ শীর্ষে হাতে বিউগলসহ ভিক্টোরি নামে অভিহিত ব্রোঞ্জের দেবী মূর্তিটি একটি কৌতূহলোদ্দীপক সংযোজন। প্রায় পাঁচ মিটার উঁচু ও 3,500 কিলোগ্রাম ওজনের মূর্তিটির বেদিতে বল-বিয়ারিং সংযোজিত। বাতাসের গতিবেগ খুব বেশি হলে জায়গায় দাঁড়িয়ে মূর্তিটি অবলীলাক্রমে ঘুরতে পারে। মনুমেন্টের বাগানকে সৌন্দর্যমন্ডিতকারী ভাস্কর্যগুলি ইটালিয় শিল্পিদের শিল্পকর্ম। উত্তর দিকে অবস্থিত আর একটি আকর্ষণীয় ভাস্কর্য হলো সিংহ-মস্তক মূর্তি। এই মূর্তিটি থেকে জলের চারটি ধারা চারটি পথে প্রবাহমান, যা ভারতের চার প্রধান নদী- সিন্ধু, গঙ্গা, যমুনা ও কৃষ্ণার প্রতীক।

কলকাতা সংক্রান্ত ছবির খুবই বড় সংগ্রহ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। কার্জন গোড়াতেই এর জন্য আলাদা প্রদর্শকক্ষের কথা ভেবেছিলেন। 1970 দশকের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী সৈয়দ নুরুল হাসান আবার এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। 1986-তে তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হয়ে আসেন। রাজ্যপাল পদাধিকার বলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অছিপরিষদের সভাপতি। এ দিকে কলকাতার তিন শতক পূর্তিও তখন এগিয়ে আসছে (যদিও বর্তমানে মহামান্য আদালতের নির্দেশে কলকাতার ‘জন্মদিন’ পালন আইনানুগ নয়)। নুরুল হাসানের উদ্যোগেই ঐতিহাসিক অশীন দাশগুপ্ত ও বরুণ দে-র পরিকল্পনায় ভিক্টোরিয়ায় স্থাপিত হল কলকাতা-গ্যালারি, ভারতে প্রথম কোনও শহরকে নিয়ে এমন গ্যালারি হল। এখানে জব চার্নকের আগমন থেকে 1911-য় রাজধানী স্থানান্তর পর্যন্ত কলকাতার ইতিহাস ছবি, মডেল, ডায়োরামা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে।

রানী ভিক্টোরিয়ার বিবাহের ছবি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

ভিক্টোরিয়ায় অস্ত্রশস্ত্রের সংগ্রহও খুব ভাল। পলাশির প্রান্তর থেকে 1757-য় ক্লাইভের দখল করা দু’টি ফরাসি কামান, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কামান ছাড়াও আছে টিপু সুলতান ও হায়দার আলির অস্ত্র,ওয়ারেন হেস্টিং ও ফিলিপ ফ্রান্সিসের ডুয়েলের পিস্তল, ইত্যাদি|

রানী ভিক্টোরিয়ার কন্যা ও তাঁর স্বামী, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার টেবিল কালীঘাট পটের এক দুর্লভ সংগ্রহ, আলোকচিত্রের দুর্লভ সংগ্রহ ছাড়াও এখানে আছে দুর্মূল্য বইপত্র, আর অজস্র নথি। আছে মিরজাফরের সঙ্গে ক্লাইভের চুক্তির মতো নথির সঙ্গে হাইকোর্ট বা পুরসভার আদি পর্বের নানা নথি।

কলকাতা নিয়ে গবেষণা করতে হলে যেমন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে যেতেই হবে, তেমনই কলকাতা বা ব্রিটিশ রাজকে চাক্ষুষ করতে হলেও ভিক্টোরিয়া ছাড়া গতি নেই। বিদেশের নানা সংগ্রহশালার সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখে ভিক্টোরিয়া, যেমন গত বছরেই লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ম থেকে কালীঘাট পটের এক দুর্লভ সংগ্রহ প্রদর্শিত হল এখানে।

স্বামীর সাথে রানী ভিক্টোরিয়া, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

এছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার টেবিল আনুষ্ঠানিক ভাবে দর্শকদের কাছে প্রদর্শন করা, রয়্যাল গ্যালারির উপরের অংশের ছবি দর্শকদের দেখার ব্যবস্থা করা, কিংবা ভিক্টোরিয়ার পিয়ানো আবার প্রদর্শনএ সবই সাম্প্রতিক নানা উদ্যোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আছে ছাত্রছাত্রী বা সাধারণ দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার মতো নানা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি গম্ভীর অ্যাকাডেমিক আলোচনার ব্যবস্থাও। কলকাতায় এমন পরিবেশে এমন সংগ্রহশালার সত্যিই জুড়ি নেই।

রানী ভিক্টোরিয়া, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বর্তমানে বহু চিত্রকর্ম, প্রাচীন পোশাক-পরিচ্ছদ ও ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলের বহু স্মৃতি বহন করে চলেছে। সব মিলিয়ে এখানে প্রায় 3,500 টি নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। বর্তমানে কলকাতায় পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।

রানী ভিক্টোরিয়া, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা 


তথ্যসূত্র :-

Government of India, Ministry of Culture, Annual report 2008–2009. p. 30

Victoria Memorial Archived 2 December 2009 at the Wayback Machine. www.iloveindia.com.

Vaughan P. "The Victoria Memorial Hall, Calcutta: conception, collections, conservation." Marg Publications, Nation Centre for the Performing Arts (India) 1997. Original from the University of Virginia. Digitized 7 April 2008. ISBN 8185026386, 9788185026381. Accessed at Google Books, 14 December 2013.

Lehman H. E. "Lives of England's monarchs." AuthorHouse, 2005. p390. ISBN 1-4184-9692-8, 9781418496920. Accessed at Google Books, 13 December 2013.

Herbert E. W. "Flora's empire: British gardens in India." Penn Studies in Landscape Architecture, University of Pennsylvania Press, 2012. p224. ISBN 0-8122-0505-7, 9780812205053. Accessed at Google Books, 13 December 2013.

Dutta K. "Calcutta: a cultural and literary history." S – 131. ISBN 1-902669-59-2, 9781902669595. Accessed at Google Books, 13 December 2013."

Archived copy". Archived from the original on 12 February 2015. Retrieved 12 January 2014.

Gordon D. (ed.) "Planning twentieth century capital cities." Planning, History and Environment Series. Routledge, 2006 p182. ISBN 0-203-48156-9, 9780203481561. Accessed at Google Books, 13 December 2013.

"History of the Victoria Memorial Hall". Official Website of the Victoria Memorial Hall. Archived from the original on 13 June 2003.



Comments

  1. তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। এটা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ঋদ্ধ হলাম

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, আশীর্বাদ করুন যাতে আরও বড় হতে পারি |

      Delete
  2. তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। এটা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ঋদ্ধ হলাম

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

      Delete
  3. খুবই ভালো লাগলো, চোখের সামনে ইতিহাসের ছবি ফুটে উঠলো। আরো এইরকম তথ্য সমৃদ্ধ লেখা পড়ার ইচ্ছে রইলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম, আপনাদের অনুসরণ করেই পথ চলা শুরু করেছি, ঈশ্বরের আশীর্বাদ থাকলে আগামীদিনে আরও লেখার সুযোগ পাবো, এভাবেই পাশে থাকবেন সর্বদা |

      Delete
  4. অনেক কিছু তথ্য পেলাম

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ভারতীয় জাদুঘর

বাঙালির নাট্যচর্চা ও রঙ্গমঞ্চ । কলমে - সুতপা দত্ত