বাঙালির নাট্যচর্চা ও রঙ্গমঞ্চ । কলমে - সুতপা দত্ত

 

বাঙালির নাট্যচর্চা ও রঙ্গমঞ্চ

বাঙালি সর্বতোভাবে সংস্কৃতি মনষ্ক এবং সাহিত্যানুরাগী চারুকলা প্রিয় বিদগ্ধ জাতি। যা কিছু সৃষ্টিশীল তাই বাঙালির চিত্ত বিনোদন করে এসেছে। সে সাহিত্যচর্চাই হোক বা সঙ্গীত চর্চাই হোক বা নাট্য চর্চাই হোক। বাঙালির নাট্যচর্চা যখন শুরু হয় তখন নগর কলকাতার বয়েস সবে একশো বছর। সবেমাত্র নগরায়নের সূচনা হচ্ছে।তখনো কলকাতা জুড়ে জঙ্গল, ধানখেত, মেঠোপথ। চওড়া রাস্তা হয়তো তখনো কল্পনাতেই আছে।বিদ্যুতের আলো আসেনি,সংবাদ পত্র আসেনি।যান বাহন বলতে তখনো পালকি।যদিও কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ-ষাট বছরের মধ্যেই ইংরেজরা তাদের বিনোদনের জন্য তৈরি করেছিল ‘চৌরঙ্গী থিয়েটার’। কিন্তু তখন পর্যন্ত বাংলা ভাষায় নাটক লেখা বা অভিনয় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেননি কেউই।কারণ নাটক লেখার উপযুক্ত বাংলা গদ্যের তখনো জন্ম হয়নি।  এই ভাবনা চিন্তা প্রথম করেছিলেন একজন বিদেশী-গেরোসিম স্তেফানোভিচ লেবেডফ। তিনিই সূচনা করেছিলেন বাংলা ভাষায় প্রথম নাট্যাভিনয়।


 লেবেডফকেই বলা যায় বাংলা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা,অনুবাদক, নাট্যপ্রযোজক। রাশিয়ার ইউক্রেনের এক কৃষিজীবী পরিবারে তার জন্ম। তিনি তার মাতৃভাষা রুশ ছাড়াও নিজের একান্ত ব্যাক্তিগত চেষ্টায় ইংরাজি,ফরাসি, জার্মান,সংস্কৃত ,হিন্দুস্থানি  ও বাংলা ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন।

লেবেডফ রুশ রাজদূতের সঙ্গী হয়ে প্রথমে নেপেলস যান। সেখান থেকে তিনি প্যারিস,লন্ডন ও ইতালি ভ্রমণ করেন এবং বেহালা বাদনে দক্ষতা অর্জন করেন। ১৭৮৫ সালে তিনি কলকাতায় আসেন এবং হিন্দুস্তানি,সংস্কৃত এবং বাংলা ভাষায় গবেষণা করেন জনৈক গোলোকনাথ দাসের সহায়তায়। তিনি জড্রেল রচিত’ ডিসগাইজ’(কাল্পনিক সংবদল) এবং মলিয়ের রচিত ‘লাভ ইজ দি বেস্ট ডক্টর’ নাটক বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি কলকাতার ডোমতলায় (বর্তমানে এজরা স্ট্রীট) বেঙ্গলি থিয়েটার নামে একটি রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। এবং দশজন বাঙালি অভিনেতা এবং তিনজন বারাঙ্গনা কে অভিনয়ের শিক্ষা দিয়ে ১৭৯৫ সালের ২৭শে ডিসেম্বর ‘ডিসগাইজ’ এর একটি অঙ্কের অভিনয় করান। দ্বিতীয়বার এর অভিনয় হয় পরের বছর ২১শে মার্চ। এভাবে তার প্রচেষ্টায় কলকাতা তথা বাংলায় নাট্য প্রদর্শণী শুরু হয়।

এই অভিনয়ের মাধ্যমে বেশ কিছু তথ্য প্রমানিত হল।জানা গেল, পুরুষ ও মহিলারা একই সময়ে অভিনয়ে এসেছেন।তাছাড়া বিনোদন শুধুমাত্র বিত্তশালীদের জন্য নয়,সর্বসাধারণ ও উপভোগ করতে পারেন। এছাড়াও জানা যায় সে সময়ে কি ধরনের গদ্য ভাষা ব্যবহৃত হত। প্রথম বিজ্ঞাপন টি ছিল-

“গবর্ণর জেনারেল অনুমতি প্রমান-

লেবেডফ মহাশএর

নওব নাচঘর নং ২৫ ডোমতলার পথে-

এক বাঙালি সংবদল নামে প্রকাস করা হইবেক-

কাল নাচ হইবেক এই মাহ ১৪ অগ্রহায়ন ইংগরাজি ২৭ নবার

বেলাতি আর বাঙালি জনত্রের সহিত গিতবাদ্য হইবেক-

শ্রী ভারতচন্দ্র রায়ের কবিতা জনত্রের গান হইবেন-

নিচের বারান্দা ও ঘরের ভিতর সিককা ৮

উপরের বারান্দা ৮

নাচের টীকিট নাচঘরে পাওয়া যাইবেক”

 

টিকিট কেটে এবং পুরুষের সাথে মেয়েদের নিয়ে নাট্যাভিনয় হল, কিন্তু সেই প্রথম নাট্যাভিনয় আমাদের পরবর্তী নাট্যরচনা ও অভিনয়ে বিবর্তনের স্থায়ী ছাপ রেখে গেল না।অভিনয়ের উপযুক্ত মৌলিক বাংলা নাটকলেখা হল আরো ৬৩ বছর পরে। রামনারায়ন তর্করত্ন লিখলেন অভিনয় যোগ্য প্রথম বাংলা নাটক ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’ যা অভিনীত হল ১৮৫৮ তে। কিন্তু জমিদারবাবুদের পৃষ্ঠপোষকতায় নাটক অভিনীত হত তাদের গৃহপ্রাঙ্গনে ফলে সাধারণ মানুষের তা দেখার সুযোগ হত না। লেবেডফের ‘বেঙ্গলি থিয়েটার এর পর প্রথম বাঙালি প্রতিষ্ঠিত প্রসেনিয়াম থিয়েটার হল প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দু থিয়েটার’।

 বাঙালির সেই প্রথম নাট্যাভিনয়ের সময় লিখিত বাংলা গদ্যের আবির্ভাব হয়নি। বাংলা গদ্যের জনক রাম মোহন রায় তখনো লেখা শুরু করেননি।যখন ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা হল তারপর কেরি সাহেবের উদ্যোগে কিছু বাংলা পাঠ্য গদ্যের লেখা শুরু হল।তারমানে ১৭৯৫ সালে লেবেডফের সামনে কোন প্রামান্য নাটক তো দূরস্থান, বাংলা গদ্যের ও কোন   আদর্শ  ছিল না। সম্ভবত তিনি প্রচলিত কথ্য ভাষা শুনেই সেই নাটকে ব্যাবহার করেছিলেন। নাট্য ঐতিহাসিক ড. অজিত কুমার ঘোষ মন্তব্য করেছেন,” প্রসেনিয়াম থিয়েটারে সংলাপাশ্রিত ক্রিয়া প্রধান,সুসংবদ্ধ কাহিনীযুক্ত নাটকের প্রথম নিদর্শন রূপে নাটকটির মূল্য আছে। ......বাস্তবধর্মী গদ্য না্ট্য সংলাপের ভাষার নিদর্শন রূপে এই নাটকেরভাষার যেমন গুরুত্ব আছে, তেমন তখনকার ভাষায় কী ধরনের শব্দ ও বাগবিধি ব্যাবহার হত তারও নিদর্শন রূপে নাটকটির মূল্য রয়েছে।“

সেকালের ইংরেজ সহায়ক সম্ভ্রান্ত শ্রেণীটি অর্থাৎ সমাজপতিরা লেবেডফ ও বাঙালির সেই প্রথম নাট্যাভিনয়ের প্রতি মোটেই প্রসন্ন ছিলেন না। কারণ তাদের বিধানে থিয়েটার বা নাট্যাভিনয় ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ বস্তু।তাই শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা তাদের প্রতিদ্বন্দী ভেবে লেবেডফের থিয়েটারে আগুণ ধরিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এমন ভাবে লেবেডফকে দেনায় জড়িয়ে দেউলিয়া ঘোষনা করে দেয় যে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন ১৭৯৭ সালে।কিন্তু এইভাবে কি ইতিহাসকে আটকানো যায়? সমাজ বিকাশের সব তথ্য ইতিহাসে থেকেই যায়। বিদেশী যুবক গেরেসিম লেবেডফ তাই জড়িয়ে আছেন বাংলা নাট্য সংস্কৃতির পিতৃপুরুষ রূপে।স্মরনীয় হয়ে আছে১৯৭৫ এর ২৭শে নভেম্বর দিনটি।



       যেদিন সাধারণ মানুষের কাছে রঙ্গমঞ্চের দ্বার উন্মুক্ত হয়েগিয়েছিল অর্থাৎ ৭ই ডিসেম্বর ১৮৭২ -সেদিনটিও ইতিহাসে স্মরনীয় হয়ে থাকবে।

হঠাৎ একদিন সাধারন রঙ্গালয় গড়ে ওঠেনি, পেছনে আছে তার বিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাস। লেবেডফ পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে শিক্ষিত বাঙালির মননে,সৃজনে,যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে গেছে।হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়েছে,বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনা শুরু হয়েছে,প্রবর্তিত হয়েছে সতীদাহ নিবারণী আইন।ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি তখন ইংরেজ দের লঘু রসাত্মক নাট্যাভিনয় দেখে আহ্লাদিত।দেশীয় ধারার বিনোদনের পরম্পরা ,যাত্রা,কবিগান,আখড়াই তাদের কাছে ব্রাত্য। প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের মত অভিজাতরা নিজেদের বাগান বাড়িতে ইংরাজি ভাষায় বা সংস্কৃত ভাষায় নাট্যাভিনয় করাতেন। সাধারন মানুষের প্রবেশাধিকার থাকতো না। বাংলা সমাজ জীবনের যেমন প্রতিফলন থাকতো না তেমন সাহিত্য গুণান্বিত মৌলিক নাটক ও লেখা হত না।

 ১৮৫৮ সালে বাংলার নাট্যক্ষেত্রে প্রবল আবির্ভাব হল মধুসূদন দত্তের,’শর্মিষ্ঠা’ নাট্য রচনার মধ্যে দিয়ে। যা অভিনীত হল ১৮৫৯ এ মহারাজা যতীন্দ্রমোহনের বেলগাছিয়া নাট্যশালায় ১৮৬০ এ দীনবন্ধু মিত্র লিখলেন ‘নীলদর্পণ’।

১৮৬৮ সালে অ্যামেচার থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হল বাগবাজারে। বাগবাজারের কিছু উতসাহী যুবক-অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি,রাধামাধব কর,গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ নাট্যদল গঠন করে অভিনয় করালেন দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’। এদের মধ্যে অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষের সহযোগী আবার যোগ্য প্রতিদ্বন্দীও বটে। তিনি গিরিশচন্দ্র ঘোষ্ কে ১৮৭২ সালে জাতীয় থিয়েটার গড়তে সহায়তা করেন।গিরিশচন্দ্রের মতে ,অর্ধেন্দু শেখর যে অংশে অভিনয় করতেন তা অননুকরনীয় হত। অমৃত লাল বসু অর্ধেন্দু শেখর কে ‘বিধাতার হাতে গড়া অভিনেতা’ বলে বর্ণনা করেছিলেন তিনি পুরুষ এবং মহিলা উভয় চরিত্রেই অভিনয় করতে পারতেন।



   গিরিশচন্দ্র ১৮৬৭ সালে বাগবাজার সখের যাত্রাদল প্রযোজিত মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের গীতিকার হিসেবে নাট্যজগতে প্রবেশ করেন। পরে দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ তে নিমচাদের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৮৭১ সালে বাগবাজার দল ন্যাশনাল থিয়েটার নামে প্রথম রঙ্গমঞ্চ স্থাপন করে অভিনয় আরম্ভ করে। অর্ধেন্দুশেখর, অমৃতলাল প্রমুখ পরিকল্পনা করেন বিত্তশালীদের কৃপাপ্রার্থী না হয়ে টিকিট বিক্রয় করে সর্বসাধারণ কে নাট্যাভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ করার। কিন্তু গিরিশচন্দ্র এর প্রবল বিরোধিতা করে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে দলত্যাগ করেছিলেন।এমনকি ছদ্মনামে সংবাদপত্রে এই উদ্যোগের নিন্দাবাদ করেন। গিরিশচন্দ্রের হাত ধরে বাংলার নাট্যচর্চার নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ১৮৮৪ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর স্টার থিয়েটার এ মঞ্চস্থ হয় নটী বিনোদিনী অভিনীত ‘চৈতন্যলীলা’। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এই নাটক দেখতে আসেন এবং বিনোদিনীর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি গিরিশঘোষকে অকুন্ঠ আশীর্বাদ করেন। এই ঘটনায় গিরিশচন্দ্রে মনে এক বিরাট পরিবর্তন আসে এবং তিনি রামকৃষ্ণ দেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।শুধু তাই নয়, ধর্মভাবে অনুপ্রানিত হয়ে বহু পৌরানিক ও ভক্তিমূলক নাটক রচনা করেন। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল অভিমন্যু বধ(১৮৮১), সীতার বনবাস(১৮৮১), সীতাহরণ(১৮৮২),প্রফুল্ল(১৮৮৯), জনা(১১১৮৯৪), আবু হোসেন(১৮৯৬) ইত্যাদি।



সেই শুরু আমাদের পেশাদারী মঞ্চ ও মঞ্চাভিনয়ের।নানা ভাঙ্গা গড়ার, উত্থান-পতন, শাসকের রক্তচক্ষু,বিরোধ-মিলনের সাক্ষী হয়ে, অর্ধেন্দুশেখর, অমৃতলাল, গিরিশচন্দ্র,অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী, প্রভাদেবী, শিশির ভাদুরী হয়ে সে ধারাবাহিকতা আজও বহমান। এই সাফল্যে উতসাহিত হয়ে উনিশ শতকে বাঙালিরা কলকাতায় বেশ কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মান করেন। যেমন- হিন্দু থিয়েটার(১৮৩১), ওরিয়েন্টাল থিয়েটার(১৮৫৩), জোড়াসাকো নাট্যশালা(১৮৫৪), বিদ্যোতসাহিনী মঞ্চ(১৮৫৭)ইত্যাদি। কয়েকটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলাম।



 

এমারেল্ড থিয়েটারঃ-

১৮৮৭ সালে কলকাতার কলুটোলা নিবাসী গোপাল লাল শীল এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বহু অর্থ ব্যয় করে থিয়েটারের জন্য জাকজমক পূর্ণ পোশাক পরিচ্ছদ ও দৃশ্যপট তৈরি করান এবং গ্যাসের আলোর পরিবর্তেডায়নামোর সাহায্যে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যাবস্থা করেন। প্রতিষ্ঠা বছরেই ৮ই অক্টোবর থিয়েটারের উদ্বোধন দিবসে কেদারলাল চৌধুরীর একখানি পৌরানিক নাটক মঞ্চস্থ হয়। কিন্তু দক্ষ পরিচালনার অভাবে দর্শক সংখ্যা ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে। এই অবস্থায় গোপাল শীলের আমন্ত্রণে গিরিশ ঘোষ এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কয়েকখানি নতুন ও পুরোনো নাটক মঞ্চস্থ করেন। সেগুলির মধ্যে ‘পূর্ণচন্দ্র’ ও ‘বিষাদ’ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।

এছাড়াও কেদারলাল রায়,দীনবন্ধু মিত্র,ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৪০ খানা নাটক এমারেল্ড থিয়েটারে অভিনীত হয়।

 

ওরিয়েন্টাল থিয়েটারঃ

১৮৫৩ সালে কলকাতার ২৬৮ নং গরাণহাটা, চিতপুরে গৌরমোহন আড্ডির ওরিয়েন্টাল স্কুলে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।প্রধানত স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্ররাই অভিনয়ে অংশ গ্রহণ করতেন। শেক্সপীয়ারের বিভিন্ন নাটক এখানে অভিনীত হয়। এর ব্যয় নির্বাহ হয় টিকিট বিক্রয়ের অর্থ দিয়ে,যেহেতু এটি কোনো বিত্তবানের প্রসাদের থিয়েটার ছিলনা। এর নাট্যাভিনয়ের বিবরণ সমূহ সংবাদ প্রভাকর,বেঙ্গল হরকরা, হিন্দু প্যাট্রিয়ট ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হত।


 

গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারঃ

১৮৭৩ সালে ভুবন মোহন নিয়োগী কলকাতার বিডন স্ট্রীটে(বর্তমান মিনার্ভা থিয়েটার স্থলে) এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। কিছুদিন পর কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চটি লিজ নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামে পরিচালনা করেন। মাত্র চারমাসের মধ্যেই কৃষ্ণধন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে ভুবন মোহন নিজের হাতে নিয়ে পূর্বনামে  চালাতে থাকেন.১৮৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে অমৃতলাল বসুর ‘হীরকচূর্ণ’ ও উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী’ নাটক এখানে অভিনীত হয়। ‘হীরকচূর্ণ’ নাটকে বাংলার রঙ্গমঞ্চে প্রথম রেলগাড়ি দেখানো হয়।

 

জোড়াসাঁকো নাট্যশালাঃ

প্যারীমোহন বসু ১৮৫৪ সালে তার কলকাতাস্থ জোড়াসাঁকো বারানসী ঘোষ স্ট্রীটের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ বছর ই ৩ মে এই মঞ্চে শেক্সপীয়ারের ‘জুলিয়াস সীজার’ নাটকটি অভিনীত হয়। মহেন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণধন দত্ত, যদুনাথ চট্ট্যোপাধ্যায় প্রমুখ অংশ গ্রহণ করেন।

 

বিদ্যোৎসাহিনী সভাঃ

১৮৫৭ সালে উত্তর কলকাতার জোড়াসাকো সিংহ বাড়ীতে কালীপ্রসন্ন সিংহ এর প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল কালীপ্রসন্নের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যোতসাহিনী সভার নামক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ। প্রাক স্বাধীনতা কালে আমাদের নাট্য ঐতিহ্যের আর একটি যুগান্তকারী বাঁক এসেছিল ১৯৪৪ এ।

বিশশতকের চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি পেশাদারী মঞ্চে শুরু হয় ক্ষয়ের কাল। অর্ধেন্দুশেখর,-গিরিশ-অমরেন্দ্রনাথের যুগের শেষ প্রতিনিধি শিশির কুমার ভাদুরী তখন পেশাদার মঞ্চের নিঃসঙ্গ সম্রাট। ১৯৪০ এর দশকটা ছিল উত্তাল সময়। ১৯৪২ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের শুরু। ১৯৪৩ এ দেখা দিল মানুষের তৈরি ভয়ঙ্কর মন্বন্তর। লক্ষ লক্ষ মৃত্যু আর সামাজিক অবক্ষয়ের যন্ত্রনার গভীর থেকে জন্ম নিল আর এক সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগ্রাম আর সেই সংগ্রামের অভিঘাতে জন্ম নিল  এক নতুনতর নাট্যধারা,বলা যায় নাট্য আন্দোলন-গণনাট্য আন্দোলন। ভারতীয় গণনাট্যসংঘের নেতৃত্বে। এর প্রথম পুরোহিত বিজন ভট্টাচার্য। এরপর এলেন শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চাশের দশকে উঠে এলো অসংখ্য গ্রুপ থিয়েটার। বাংলা থিয়েটারে বিস্ফোরণ ঘটে গেল। এই প্রায় দুশো বছরের সময় কালে বাঙালির নাট্যচর্চায় ঘটলো সম্পূর্ণ বদল। পৌরানিক বা ভক্তিনির্ভর কাহিনী থেকে  সামাজিক পালাবদলের এক সম্পূর্ণ চিত্র আমরা দেখতে পাই বাঙালির না্ট্যচর্চার ইতিহাসে।

 তথ্যসূত্রঃ--বাংলা নাটকের পথচলা- সমকালীন সমাজ ও সময়।

বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস

ছবি - আর্ন্তজাল 

©সুতপা দত্ত

Comments

Popular posts from this blog

ভারতীয় জাদুঘর

'ভিক্টোরিয়া-মেমোরিয়াল' - ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের এক গৌরবজ্জ্বল সৃষ্টি