পুরনো কেল্লার পুরনো গল্প - অথ ফোর্ট উইলিয়াম কথা
পুরনো কেল্লার পুরনো গল্প - অথ ফোর্ট উইলিয়াম কথা
প্রজ্ঞা পারমিতা
শহর কলকাতার একটি গড় আছে। ডিহি কলকাতায়ও একটি গড় ছিল। সেই গড় ঘিরেই আমার শহরের গোড়াপত্তন। মুক্তো সৃষ্টির পদ্ধতিটা মনে করুন। ঝিনুকের বন্ধ খোলের মধ্যে একটি বালি কণা জাতীয় জলবাহিত ‘ফরেন পার্টিকল’ প্রবেশ করলে তাকে ঘিরে পরতের পর পরত তৈরি হতে থাকে এবং শেষে পাই একখানি অনাবিল মুক্তো! ঠিক সেই ভাবেই যেন প্রাচীন গ্রাম 'কলিকাতা' রূপান্তরিত হয় শহর কলকাতায় । এবং অবশ্যই সেই ফরেন পার্টিকল এক্ষেত্রে জোব চার্নক। কোর্টের দোহাই দিয়ে অনেকে রেরে করে উঠতেই পারেন কিন্তু ডিহি কলকাতা থেকে শহর কলকাতা গড়ে ওঠার ইতিহাসের সূচনা বিন্দু যে সুতানুটির স্বল্পালোচিত মোহন টুনি নামক ঘাটে ওই কাল নির্দিষ্ট পুরুষটির নামা এই বিষয়ে সম্ভবত দ্বিমত হওয়ার কোন অবকাশ নেই।
অবশ্যই ব্রিটিশ অনুপ্রবেশ না ঘটলেও ভাগীরথীর এই পূব পাড়ে দ্বিতীয় সপ্তগ্রাম গড়ে উঠত। কারণ সরস্বতী মজে গিয়ে সপ্তগ্রামের দিন ফুরিয়েছে তখন। কালের পাখি সেই স্থান ছেড়ে নদীর বাঁকে এই সুতানুটিতে এসে বসেছে ষোড়শ শতকেই। সাতগাঁয়ের বণিককুল শিরোমণি শেঠ বসাকরাও একূলে ভিড় করেছেন । প্রকৃত প্রস্তাবে সেটাই টার্নিং পয়েন্ট ধরা উচিত এই এলাকার সমৃদ্ধি সূচনার! কিন্তু ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনের তোড়ে ভেসে গেছিলো সে সব কথা! হলে কি হবে ইতিহাস যে অনেকটা সাগরের মতো! হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছু আবার উঠে আসে! এখন যেমন আমরা সম্যক বুঝেছি শেঠ বসাকদের সুতানুটি পর্ব থাকবেই কোম্পানির কলকাতা পর্বের আগে!
সপ্তদশ শতকের শেষার্ধে কোম্পানির চিঠিপত্রে ‘গ্রেট বাজার’ বা বড় বাজারের উল্লেখ আছে। বোঝা যায় তখনই এক বর্ধিষ্ণু বন্দর হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছিল এ তল্লাট। সুতরাং ব্যবসার সুবিধার্থেই ইংরেজরা এখানে আসে । মোহনা থেকে দূরত্বের কারণে হুগলী বা উলুবেড়িয়া বাতিল করে এইখানে বাণিজ্য ঘাঁটি করা ছিল এক সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। মোটেই কোন ‘হঠাৎ ঘটা’ঘটনা নয় যেমন নাকি একদেশদর্শী কিপলিং সাহেব বলেছিলেন কলকাতা সম্পর্কে – “চান্স ডিরেক্টেড, চান্স ইরেক্টেড”! অতঃপর কে না জানে কোন স্থানের উন্নতি বণিকের বসতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত।
এবার আসি গড় গড়া প্রসঙ্গে। পুরনো কেল্লার চরিত্র বুঝতে গেলে আগে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ফোর্ট শব্দের অর্থে চোখ বুলিয়ে নিলে সুবিধে হবে। সেখানে দ্বিতীয় অর্থ হিসেবে বলা আছে ‘ট্রেড স্টেশন’। অন্যত্রও লেখা হয়েছে পুরাতন অর্থে ‘ট্রেডিং পোস্ট’। ঠিক এই অর্থেই প্রথম ফোর্ট উইলিয়ামের অবতারণা হয়েছিল। কারণ তখনও তারা বণিক এবং ‘মানদণ্ড’ যে ‘রাজদণ্ডে’ বদলাতে পারে সে সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। পুরনো কেল্লা ঠিক ওই পরিবর্তনের ‘শর্বরী’র ইতিহাসটুকুর সাক্ষী ছিল। এই শহর তার একমাত্র যুদ্ধ দেখেছে ওই পুরনো কেল্লা ঘিরেই। তাই কলকাতার ইতিহাস প্রেমীদের পুরনো কেল্লার কাছে ফিরতেই হয় বারবার।
এই সময়টা সবচেয়ে আবছায়া এবং তার পুনর্নির্মাণ করতে ঐতিহাসিকদের নির্ভর করতে হয়েছে কোম্পানির দস্তাবেজের ওপর। এছাড়া কোম্পানির অনেক কেষ্টবিষ্টু কলম ধরেছিলেন যেখানে স্পষ্টতই তাঁদের রণ-রক্ত-সফলতা কিঞ্চিৎ আরোপিত হয়ে প্রতিফলিত। তবু তার মধ্যে থেকেই নিরপেক্ষ তথ্য তুলে নিয়ে সেই সময়ের বাস্তব ছবি আঁকার চেষ্টা করতে হয়।
সি আর উইলসন সাহেবের দেয়া তথ্য বলছে হুগলী নদীর মোহনার কাছাকাছি একটি পাকাপোক্ত বাণিজ্য ঘাঁটি করার ভাবনা প্রথম আসে স্যার উইলিয়াম হেজেসের মাথায় যিনি ১৬৮২ থেকে ১৬৮৪ অবধি ছিলেন বঙ্গোপসাগরীয় এলাকার ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাফেয়ার্সে’র দায়িত্বে। ইন্ডিয়া হাউসে সংরক্ষিত দস্তাবেজ বলে যে ১৬৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে লেখা একটি চিঠিতে কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টরসদের একটি বাণিজ্য ঘাঁটি গড়ার নির্দেশ দিতে দেখা যায় সুতানুটিতে, বানান অবশ্য ‘chutanutte’। কোম্পানির কাগজপত্রে ‘Calcutta’ শব্দটির প্রথম উল্লেখ দেখা যায় ১৬৮৮ সালে, ঢাকার কোম্পানি কর্মী চার্লস আয়ার এবং হুগলীর কোম্পানি এজেন্ট জোব চার্নক দুজনের নাম যেখানে উল্লেখিত।
জোব চার্নক ১৬৯০ সালে আগস্ট শেষের এক বাদলা দিনে তৃতীয় বারের জন্য সুতানুটিতে নেমে টানা আড়াই বছর বাস করে গত হলেন ১৬৯৩ সালের জানুয়ারিতে । চার্নকের হাতে গড়ের পত্তন হয়নি। ‘গুড ওল্ড ডেস অফ অনারেবল জন কোম্পানি’ সখেদে লিখেছে যে লোকটাকে নিয়ে অকারণ মাতামাতি হয়, কিছুই তো তেমন মহিমান্বিত করে যায়নি!- “In 1691 we find Charnock residing in chuttanutte with hundred soldiers but without either storehouses or fortifications. He died the next year in January. His name is inseparably associated with the metropolis of British India, which he was accidentally the instrument of establishing, but there does not appear to have been anything great or even remarkable in his character.”
সুতানুটিকে নির্বাচন করাটাই চার্নকের মহিমান্বিত কাজ এবং সেটাকেই অবজ্ঞা ভরে ‘হঠাৎ ঘটা’ ঘটনার তকমা দেয়ার স্বভাবটি দেখা যাচ্ছে সব সাহেবদেরই একচেটিয়া ছিল। তবে এখানে বলি যে চার্নক নিমিত্ত মাত্র। স্থান মাহাত্মের কল্যাণে ইংরেজের এখানে আসাটাই সময়ের দাবি ছিল।
সে যাই হোক চার্নকের মৃত্যুর পর চিফ গভর্নর অফ কোম্পানি সেটলমেন্ট স্যার জন গোল্ডসবরো সুতানুটিতে এসে যা দেখলেন তাতে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হলেন। গঙ্গা তীরে পরিকল্পনাহীন ভাবে যত্রযত্র কিছু নির্মাণ ছড়িয়ে আছে! এই নাকি পূর্ব ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্ভাব্য কেন্দ্র! সর্বোপরি ঔরঙ্গজেব ১৬৯০ সালে বাংলায় ব্যবসা করার অধিকার দিয়েছে বটে কিন্তু বাণিজ্য ঘাঁটি গড়ার একটা লিখিত ছাড়পত্র চাই তো! নবাব বাদশাদের মেজাজ মর্জির কোন ঠিক ঠিকানা আছে নাকি! দিল্লিতে মোগলরা সদয় হয় তো বাংলার নবাবরা বিগড়ে যায়! অতএব গোল্ডসবরো সময় নষ্ট না করে প্রথমে মাটির দেওয়াল তুলে একটা বিস্তৃত এলাকা নির্বাচন করে ঘিরে রাখলেন গড় তৈরির জন্যে। কিন্তু আঞ্চলিক শাসকের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে পরিস্থিতি কিছুতেই অনুকূলে যাচ্ছিল না তাদের। এমন সময় ১৬৯৫ সালে মেদিনীপুর অঞ্চলের এক সামন্ত শোভা সিং রেরে করে ত্রাস সৃষ্টি করলো রাজমহল থেকে নিম্ন গাঙ্গেয় সমতলভূমি অবধি। তার হাত থেকে বাঁচতে ফরাসি, ওলন্দাজদের মতো উপনিবেশকারীরা সবাই তাদের ঘাঁটি মজবুত করতে উদ্যোগী হল। কোম্পানিও এই সুযোগটা কাজে লাগালো। সুরক্ষার প্রয়োজন দেখিয়ে আঞ্চলিক প্রশাসকের কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি আদায় করে নিল এবং ঝাঁপিয়ে পড়ল নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে।
গড় তৈরির দায়িত্ব নিলেন সুযোগ্য এবং দায়িত্ববান স্যার চার্লস আয়ার যাকে গোল্ডসবরো অযোগ্য ফ্রান্সিস এলিস কে সরিয়ে সুতানুটির এজেন্ট করেছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া থিংক ট্যাংক ১৬৯৪ সালে আয়ারকে গভর্নর নিযুক্ত করে। প্রসঙ্গত জানাই চার্লস আয়ার ব্রিটিশ সেটলমেন্টের ভিত গড়ার একজন অন্যতম স্থপতি হয়েও অত্যন্ত কম আলোচিত। হ্যাঁ, ইনিই পূর্বোক্ত ওই দস্তাবেজের চার্লস আয়ার। কর্ম কুশলতায় মুগ্ধ করে বিলেতের দরবার থেকে সদ্য স্যার হয়ে ফিরলে ১৬৯৬ সালে তার হাতেই শুরু হয় গড়ের গোড়াপত্তন। এই আয়ার সাহেবের আরেকটি পরিচয় হল তিনি জোব চার্নকের জামাতা। চার্নক ও তাঁর ভারতীয় স্ত্রীর কন্যাদের মধ্যে প্রথমা কন্যা মারির স্বামী। জোব চার্নকের যে সমাধিটি দেখি আমরা সেন্ট জন'স চার্চে তা আয়ার সাহেব নির্মিত। ১৬৯৮ সালে বাংলার সুবাদার আজিম উস শানের কাছ থকে কাগজে কলমে ছাড়পত্র পেয়ে সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে তিনটি গ্রাম জায়গির নেওয়ার যে চুক্তি হয় সেই কাগজে চার্লস আয়ারই সই করেছিলেন, যে দলিল ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে। বাংলা প্রসিডেন্সি ঘোষিত হলে আয়ার হন তার প্রথম প্রেসিডেন্ট।
গড় প্রসঙ্গে ফিরে আসি; যদিও অত্যন্ত দ্রুত সম্পূর্ণ হওয়া দরকার ছিল কিন্তু পাঁচ ছ বছর সময় লেগে যায় তার প্রাথমিক কাজটুকু অর্থাৎ প্রাকার ও একটি গভর্নর হাউস বা কুঠি বাড়ি তৈরি করতে। তার অবশ্য বিশেষ কারণও ছিল যে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। গোল্ডসবরোর নির্বাচিত এলাকার দক্ষিণ পূর্ব কোণ থেকে দু দিকে প্রাকার তুলে ফোর্ট নির্মাণ শুরু হয়। আয়ার পরবর্তি গভর্নর বিয়র্ডের দায়িত্বে শুরু হয় কুঠি বাড়ি গড়া। ১৭০৬ সালে কোম্পানির রোটেশন গভর্নমেন্টের হাতে সেই কাজ শেষ হয়। অন্যান্য নির্মাণ দফায় দফায় চলতে থাকে যদিও আরো বহু বছর ধরে। ইতিমধ্যে ১৬৯৯ সালে মাদ্রাজ থেকে আলাদা করে বাংলাকে প্রেসিডেন্সি ঘোষণা করা হয় এবং একই সঙ্গে স্থির হয় বাংলার ফোর্ট তদানীন্তন রাজা তৃতীয় উইলিইয়ামের নামে নাম চিহ্নিত হবে।
কিন্তু সেই ফোর্টের সীমারেখা কি ছিল?!
© প্রজ্ঞা পারমিতা
তথ্যঋণঃ
Old Fort William in Bengal by C R Wilson এবং অন্যান্য
ছবি সৌজন্যে : ব্রিটিশ অনলাইন লাইব্রেরি
[ক্রমশ]
খুব ভালো লেখা। পড়তে পড়তে চোখের সামনে ছবির মত দৃশ্য ফুটে ওঠে। তাইই লেখার সার্থকতা।
ReplyDeleteতথ্য বহুল লেখা। অনেক কথাই জানা হলো
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো। very informative ।
ReplyDeleteখুব তথ্যবহুল লেখা
ReplyDelete