পুরনো কেল্লার পুরনো গল্প - অথ ফোর্ট উইলিয়াম কথা [দ্বিতীয় পর্ব]

"আমার শহর নয়কো তেমন বুড়ো; 
অতীত কালের অস্থি মুদ্রা চৈত্য বিহার কিছু
 পাবে না তার কোথাও মাটি খুঁড়ে। 
হঠাৎ কখন নদীর ধারে ব্যপারীদের নায়ে 
আমার শহর নেমেছিল কাদামাখা পায়ে… "  
  --প্রেমেন্দ্র মিত্র 
 আজকের কলকাতায় যে ফোর্ট উইলিয়াম দাঁড়িয়ে আছে সে তার নামটা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে পূর্বতন ফোর্ট উইলিয়াম থেকে, কিঞ্চিৎ ভিন্ন ভূগোলে যার অস্তিত্ব ছিল প্রায় ষাট বছর। পুরনো কেল্লার সীমা রেখা ছিল উত্তরে ফেয়ারলি প্লেস, পূর্বে নেতাজী সুভাষ রোড, দক্ষিণে কয়লাঘাট স্ট্রিট ও পশ্চিমে গঙ্গা। হ্যাঁ গঙ্গা, কারণ স্ট্র্যাণ্ড রোডের তখন অস্তিত্ব ছিল না; সেখানে তখন গঙ্গা যার জল কেল্লার দেয়ালে ও ঘাটে ছলাৎ ছল ঢেউ তুলতো। কেল্লাঘাট শব্দবন্ধের অপভ্রংশই কয়লাঘাট যা আজও পুরনো কেল্লার স্পর্শাতীত ঐতিহ্য হয়ে রয়ে গেছে। কেল্লার পুর্ব দিকে লালদিঘির অংশটিকে ট্যাঙ্ক স্কোয়ার বলা হত যেখানে সেই ট্যাঙ্কের অবস্থান ছিল এক টুকরো সবুজের মাঝ যাকে ‘Green before the fort’ অথবা ‘The park’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে পুরনো লেখাপত্রে। পুরনো কেল্লা পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে প্রায় কুড়ি বছর লেগেছিল। কোম্পানির বিভিন্ন চিঠিতে তার ধীরে ধীরে গড়ে ওঠার ইতিহাস ধরা আছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদর আপিস লন্ডনের লিডেনহল স্ট্রিট থেকে পাঠানো নির্দেশে এবং এখান থেকে খবরাখবর সমৃদ্ধ চিঠিপত্তরে ১৭০০ সালের মার্চ মাসের আগে অবধি স্থান উল্লেখ দেখা গেছে ‘Chuttanutte’। মার্চ ১৭০০ সাল থেকে ‘Fort William, Calcutta’ লেখা হতে লাগলো। কলকাতার আন্তর্জাতিক পরিচয়ের সেই মনে হয় প্রথম ধাপ।



কোম্পানির প্রথম বাণিজ্য কুঠি নিয়ে একটি ভ্রান্ত মত খুব প্রচলিত। জোব চার্নক স্থানীয় জমিদার বা কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির একটি পাকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে জমিদারি কাছারি চালাতেন – এই ধারণাটি কিংবদন্তি থেকে বিশ্বাসের জায়গায় চলে গেছিল কলকাতার মানুষের। সেই বাড়িকে কেন্দ্রে রেখেই নাকি গোল্ডসবরো সম্ভাব্য ফোর্টের দেয়াল তুলেছিলেন এই বক্তব্য ব্রিটিশরাই লিখেছিল এখানে সেখানে। কিন্তু এই তথ্যটি গবেষণা সমর্থিত নয়। ওখানে শেঠ বসাকদের কোন কাছারি বাড়ির ইতিহাস নেই এবং সাবর্ণ চৌধুরীদেরও নয়। বস্তুত পরস্পর বিরোধী কথা লিখে গেছেন নাম করা ব্যাক্তিরাই। দুটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে - সি আর উইলসন লিখেছেন, “It is said that the nucleus of the Calcutta factory was the zamindari kachari or office of the Mazumdars, near the great tank which they gave up to the English.” যদিও তিনি ফুটনোট দিয়ে কিঞ্চিৎ সন্দেহ ব্যক্ত করেছেন। লর্ড কার্জন লিখেছেন, “Goldsborough purchased a house for the company, which was a poor structure of brick and mud, and ordered it to be surrounded by a wall, i.e. to be converted into a fort as soon as permission could be obtained. Charles Eyre whom he had appointed in place of incompetent Ellis, moved into this abode, which may therefore I suppose be regarded as first government house of Calcutta. Its site is said to have been the strip of land north of the present customs house...” প্রামাণ্য ইতিহাস বলে কিছু ‘thatched and mud house’ কোম্পানির লিখিত অনুমতি পাওয়ার আগে থেকেই তৈরি করা হয়েছিল কাজকর্ম চালাতে। পরে ‘brick and mud’ নির্মিত বাড়িও তৈরি হয় এবং গোল্ডসবরো সম্ভবত তেমনই একটি বাড়ি যেটার হয়ত অবস্থা ভালো নয় কিন্তু উপযুক্ত ‘strategic position’ দেখে বেছে নিয়েছিলেন কুঠির জন্য। সারিয়ে নিয়ে চার্লস আয়ার সেখানে থাকা শুরু করেন, তাই কার্জন বলেছেন প্রকৃত প্রস্তাবে সেই ছিল কলকাতার প্রথম গভর্নর হাউস। শুধু মাত্র প্রাকার আর কুঠি হলেই তো হল না। ১৭১২ সালের চিঠিতে দেখা যাচ্ছে সদর দপ্তরে খবর পাঠানো হচ্ছে যে ‘The wharf’ সম্পূর্ণ হওয়ার পথে। গুদাম ইত্যাদি ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য প্রধান নির্মাণ তো হলই। প্রথম দিকেই একসারি মাড হাউস করা হয়েছিল রাইটারদের থাকার জন্য, ক’বছর ঘুরতে না ঘুরতে সেগুলো আবার নতুন করে করতে হয়েছিল। এই সব সেরে উঠতে উঠতে গড়িয়ে গেল ১৭১৬ সাল। অর্থাৎ পুরনো কেল্লা দফায় দফায় তৈরি হওয়ার সময় কাল হচ্ছে ১৬৯৬ সাল থেকে ১৭১৬ সাল।



কিন্তু এতটা সময় লেগে গেল কেন? এই প্রশ্নের খুব একটা সদুত্তর পাওয়া যায় না। তবে কিছু তথ্য ভেবে দেখা যেতে পারে কারণ হিসেবে। চিঠি পত্রে দেখা যায় কিছু মতভেদ তৈরি হয়েছে বারবার ইংল্যান্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কলকাতার কাউন্সিলের। যেমন সদর অফিস নির্দেশ দিয়েছিল গড় পঞ্চভুজ আকৃতির করা হোক। কিন্তু বাংলার কোম্পানি কর্মকর্তারা এমন কিছু তৈরি করতে চাইছিলেন না যা স্থানীয় শাসকের চোখ টাটায়। এসব চিঠি চালাচালিতেও সময় গেছে প্রচুর। অন্যদিকে ধারাবাহিক ভাবে দক্ষ সাংগঠনিক ক্ষমতা সম্পন্ন প্রশাসক পাওয়া যায়নি এটাও থমকে থমকে কাজ শেষ হওয়ার একটা কারণ হতে পারে। আরেকটি কারণ খুব স্বল্পালোচিত। সুতানুটিতে কুঠি তৈরি করার কথা হচ্ছে যখন তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বেশ বড় ধরণের একটা সমস্যার মধ্যে পড়েছিল। এদের আসল নাম কিন্তু লন্ডন কোম্পানি [Merchants of London trading with the East Indies]। বিলেত থেকে ভারতে তারাই একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার নিয়ে এসেছিল প্রথম। কিন্তু ১৬৯৮ সাল নাগাদ চিত্রটা বদলে গেল। ইংলিশ কোম্পানি [English company trading to the East Indies] বলে আরেকটি ব্যাবসায়ী সংস্থাকে ইংল্যান্ডের রাজশক্তি ভারতে ব্যবসা করার ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। এই দুটো কোম্পানির মধ্যে প্রবল রেষারেষি শুরু হয় এবং দুজনেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এভাবে টানা চলতে চলতে একসময় এরা বুঝতে পারে যে লাভের গুড় শান্তিতে কারও ঘরেই উঠবে না। তাই দুপক্ষই সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয় সংযুক্ত হয়ে একটি কোম্পানিতে পরিনত হওয়ার। ১৭০২ সালে এই সুতানুটিতেই প্রাথমিক একটি সংযুক্তির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এবং পরে ইংল্যান্ডে ১৭০৮ সালে লিখিত ভাবে তাদের নাম হয় United Company of Merchants of England Trading to East Indies.যদিও আমরা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামেই সন্তুষ্ট থেকেছি। বাণিজ্যিক সংস্থার একে অন্যকে গিলে ফেলা বা মিলে যাওয়ার আজকের যে চিত্র অহরহ দেখছি ঠিক তেমনই এক ঘটনার নাট্যাভিনয় তিনশো বছর আগে শহর কলকাতার বাল্যলীলায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল একথা ভাবলে একটা কথা মনে হবেই যে কলকাতা আদতে বণিকের দ্বারা বনিকের জন্য এবং একান্ত ভাবে বণিকের শহর। এর শুধু টাকার হিসেব করার কথাই ছিল। কিন্তু সে সাংস্কৃতিক রাজধানী হয়ে উঠল কি করে ?! এ যে পৃথিবীর এক অত্যাশ্চর্যতম অভিযাত্রা! তবে কি কোন এক সময়ে মিউটেশন ঘটিয়েছিল সে মূল চরিত্রে। তার ফলেই কি আমাদের মনে প্রাণে কলকাতা প্রেমের গভীর সংক্রমণ, যাতে একবার আক্রান্ত হলে আর সারে না! তাই হবে হয় তো! 
[ক্রমশ]

 তথ্যসূত্রঃ পূর্বোক্ত 
 
 ©প্রজ্ঞা পারমিতা


Comments

  1. যত পড়ছি ততই জানতে পারছি। K

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ভারতীয় জাদুঘর

বাঙালির নাট্যচর্চা ও রঙ্গমঞ্চ । কলমে - সুতপা দত্ত

অগ্নিযুগের খেলা – আগস্ট বিপ্লব ও একটি বিদ্যায়তন