পুরনো কেল্লার পুরনো গল্প - অথ ফোর্ট উইলিয়াম কথা [চতুর্থ পর্ব]
"পোল বেঁধেছে কল ফেঁদেছে
বসিয়ে বাজার হাট
রাস্তা পেতে মেলেছে ঢের রং-বেরং-এর ঠাট;
তবু যেন জংলা আদিম জলা
জুড়ে আছে আজো বুকের তলা।"
-প্রেমেন্দ্র মিত্র
পশ্চিমে ভাগীরথী আর পূর্বে বিস্তৃত লবণ হ্রদ। আরও আছে খালের কাটাকুটি, পশ্চিম থেকে পূবে। সব মিলিয়ে জলা জংলা এলাকা। ক্যাপ্টেন হ্যামিলটনের বর্ণনায়,
“This overflows in September and October, and then prodigious numbers of fish resort thither; but in November and December when the floods are dissipated those fishes are left dry, with their putrefaction so affect the air with thick stinking vapours which the north-east wind bring with them to Fort William that they cause yearly mortality. One year I was there, and there were reckoned in August about twelve hundred English, and before the beginning of January there were 460 burials registered in the clerk’s book of mortality.”
পচা মাছের গন্ধেই সাহেবরা পটাপট মারা পড়তো না হয়তো, হয়তো ওই মেছো গন্ধটাই ছিল মৃত্যুগন্ধী। কারণ ওই সময়টা আদতে ছিল হিসেব মেলানোর যে কতজন গেলো আর কতজন রইলো। সেই সময় কলকাতায় এসে একটা বর্ষা কাটিয়ে ফেলাই ছিল বেশ শংসাপত্র পাওয়ার মতো ঘটনা। কোম্পানির বড় সাহেবরা প্রতি গ্রীষ্ম-বর্ষার মুখে তাদের ইচ্ছাপত্র তৈরি করে রাখতো। প্রতিটি গ্রীষ্ম-বর্ষা কাটিয়ে উঠেই এক মহাভোজের আয়োজন প্রচলিত হয়ে যায় যেখানে কোম্পানির সর্বোচ্চ পদাধিকারী থেকে সাধারণ রাইটার বা নাবিকরা একে অন্যকে অভিনন্দিত করতো এই বলে যে “বেঁচে আছি"।
বাণিজ্যে শ্রীবৃদ্ধির জন্য কোম্পানি সুবিধেজনক অবস্থানে কুঠি গড়েছে, এখন প্রতিকূল আবহাওয়া নিয়ে ভাবলে চলে! সুতরাং নতুন বাণিজ্য কেন্দ্রে কাজের সন্ধানে শয়ে শয়ে শ্বেতাঙ্গ তরুণ আসছে। এবং শয়ে শয়েই কবরে চলেছে। তেরাত্তির দুর কেউ কেউ এক রাত্তিরও টিকতে পারেনি কলকাতায় নেমে এমনও হয়েছে। অগত্যা কোম্পানি আশু একটি হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭০৭ সালে সেই হাসপাতাল স্থাপিত হয় বর্তমান গার্স্টিন প্লেসে। প্রথমে কোন নাম ছিল না, শুধু হাসপাতাল বলেই উল্লেখিত পুরাতন নথিপত্রে বা লেখায়। সে হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ থাকলেও বাঁচার হার কহতব্য ছিল না। ক্যাপ্টেন হ্যামিলটনের মতে সে হাসপাতাল ছিল এমন জায়গা “where many go in to undergo the penance of physick, but few come out to give any account of its operation.”
পরে এই হাসপাতালের নামকরণ হয় প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতাল যেটা ১৭৬৮ স্থানান্তরিত হয় ভবানীপুরে। স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে এর নাম সুখলাল করনানি মেমোরিয়াল হসপিটাল করা হলেও আজও মুখে মুখে পি জি হাসপাতাল নামটাই ফেরে।
পুরনো হাসপাতালের স্মৃতি কোম্পানির কাছে গৌরবের না হলেও কোম্পানির এক ডাক্তারের স্মৃতি ইতিহাসে শিরোধার্য। তিনি হলেন সার্জেন উইলিয়াম হ্যামিলটন। ঘটনাক্রমে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন বাংলায় কোম্পানির ভিত শক্ত করতে। বাংলার নবাব আজিম-উস-শানের নিশান নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকার অবকাশ ছিল না কোম্পানির। কারণ ক্রমান্বয়ে আঞ্চলিক রাজনীতির পটপরিবর্তনে তাদের ব্যবসা ধাক্কা খেয়েছে বারবার। খোদ দিল্লিশ্বরের ফরমান চাই। দিল্লির গদিতে তখন বাদশা ফারুখশিয়ার। ইস্ট ইন্ডিয়া থিংক ট্যাংক তাই মোগল দরবারে দৌত্যের ব্যবস্থা করল প্রচুর উপঢৌকনসহ। দূতবাহিনীর নেতৃত্বে জন সারমন এবং এই দলের সদস্য হন কোম্পানি সার্জেন উইলিয়াম হ্যামিলটন। আরেকজনের কথা না বললে নয়, তিনি হলেন আর্মানি ব্যবসায়ী সারহেদ। শাসকের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় পদে পদে সারহেদ সাহেবের মধ্যস্থতা লেগেছে কোম্পানির। দুর্গ গড়ার মৌখিক অনুমতি আনতে, নানা দাবিদাওয়া পেশ করতে, এমন কি নবাব আজিম-উস-শানের কাছ থেকে নিশান আদায় করার সময়ও সারহেদ ছিলেন প্রধান ভরসা ইংরেজের। তার ভূমিকা অবশ্য দেখানো হয় দোভাষী হিসেবেই। কিন্তু খতিয়ে দেখলে বেশ বোঝা যাবে যে তার ভূমিকা আরও বেশি ছিল। আর্মানিরা ইংরেজদের মতোই বণিক বটে কিন্তু রাজনৈতিক উচ্চাশা ছিল না তাদের কোনদিন। এবং চিরকাল স্বল্পালোচিত থেকে গেছে তারা প্রচলিত ইতিহাস চর্চায়।
যাই হোক রাজ দরবারে দূত পাঠানোর প্রসঙ্গে ফেরা যাক। তিন মাস লাগে কলকাতা থেকে দিল্লি পৌঁছতে সারমন বাহিনীর। দরবারে তারা দারুণ অপ্যায়িত হয়। হবে নাই বা কেন। উপহারের যা বহর – “curious glass ware, clock work, brocades and the finest manufactures of woollen cloths and silks, valued altogether at thirty thousand pounds sterling.”
ফারুখশিয়ার উল্লসিত হয়ে তাদেরও ঢেলে উপহার দিলেন। বাদশাহি ব্যাপার, হাত ঝাড়লেই পাহাড়। কিন্তু কোম্পানি ওয়ালাদের তো উপহারে মন নেই। তাদের চাই বাংলায় জাঁকিয়ে বসার নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা যা বাদশাহের শিলমোহর দেয়া একখানা ফরমান ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু ফারুখশিয়ার সেসব কথা তেমন পাত্তা দেয় না। সে তখন ব্যস্ত তার নিকাহ নিয়ে। পুরো দলকে দিনের পর দিন চূড়ান্ত মোগলাই আরামে রাখা হয়েছে, কিন্তু ফরমান আর জোটে না! বাদশাহের সেদিকে মন দেয়ার অবসর নেই যে! এমন সময় নিকাহের ঠিক আগে বাদশার শরীর যায় প্রবল বিগড়ে। দরবারেই আসতে পারে না এমন অবস্থা দাঁড়ায়। বাদশার বিয়ে, বিশাল আয়োজন, নিমন্ত্রিত অভ্যাগত এসে গেছে। এহেন অবস্থায় ডাক্তার হ্যামিলটন উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। ফারুখশিয়ার সুস্থ হল তাঁর চিকিৎসায়। এবং হাতে হাতে ফল – ফরমান তো হলই, হুগলীর দুই তীরে ৩৮ খানা গ্রাম কোম্পানির নামে লিখে দিল বাদশা।
সেন্ট জনস গির্জায় হ্যামিলটন সাহেবের সমাধিতে কোম্পানি তার কৃতজ্ঞতার কথা খোদিত করে রেখেছে চিরতরে।
[উদ্ধৃতি অপরিবর্তিত]
তথ্যসূত্রঃ A new account of East Indies by Alexander Hamilton
ছবিঃঅন্তর্জাল
[ক্রমশ]
©প্রজ্ঞা পারমিতা
Comments
Post a Comment