পুরনো কেল্লার পুরনো গল্প - অথ ফোর্ট উইলিয়াম কথা [নবম পর্ব] লিখেছেন - প্রজ্ঞা পারমিতা

 

এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন
… ”

 

১৭৫৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে চন্দননগরের ফ্রেঞ্চ কাউন্সিল একটি চিঠি পাঠায় তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে যা বক্তব্য অনুবাদ করছি…

“সদ্য ঘটে যাওয়া যে ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে ইংরেজরা বাংলায় তাদের সবক’টি সেটলমেন্ট থেকে বিতাড়িত হল আমাদের ধারণা আপনারা আশ্চর্য হয়ে যাবেন একথা জানলে। আমরা সংক্ষেপে একটা বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করছি।

বাংলার নতুন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা তার মাতামহ আলীবর্দি খাঁর মৃত্যুর পর এই বছর এপ্রিল মাসেই বাংলার ‘সুবা’ হাতে পেয়েছে, যদিও তার নবাব হওয়াটা বহুসংখ্যক লোককেই অবাক করেছিল। গদিতে বসতে না বসতেই ইংলিশরা এই উগ্র স্বভাবের যুবককে অকারণ চটিয়েছে তার এক শত্রুকে আশ্রয় দিয়ে এবং চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে যার ভয়ানক মূল্য এইভাবে দিতে হল তাদের।…।”

ইংরেজের রাজনৈতিক হার ফরাসিদের কাছে চিরকাল উপভোগ্য ছিল কিনা জানি না, তবে কয়েকটি ঐতিহাসিক সত্য এমন কিছু তথ্যই দেয়। এমনকি ইংরেজের জয়ের বর্ণনাতেও তারা বিজিতের পক্ষ নিয়েছে এমন প্রমাণ পেয়েছি। টিপু সুলতানকে পরাস্ত ও নিহত করার ঘটনা নিয়ে প্যারিসে অপেরা তৈরি হয়েছিল এবং টিপুর সহমর্মিতায় হল ভর্তি লোক চোখ মুছতো। সিরাজের ক্ষেত্রে তেমন ইতিহাস থাকাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু খোঁজাখুঁজি করেও পেলাম না।অগত্যা তাদের ভাষ্য দিয়ে ভূমিকা করলাম কলকাতার যুদ্ধের।      

সিরাজ প্রথম কাশিমবাজার কুঠি আক্রমণ করে এবং তাদের সর্বেসর্বা ওয়াটসকে একটি মুচলেকায় সই করতে বাধ্য করে। ইতিহাস সমর্থিত সেই মুচলেকায় যে তিনটি শর্তের কথা লেখা ছিল সেটাই কলকাতা আক্রমণ বা ইংরেজ বিদ্বেষের প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়। শর্তগুলি হল প্রথমত ইংরেজরা নবাবের কোন পলাতক প্রজাকে আশ্রয় দেবে না। দ্বিতীয়ত কলকাতার কেল্লায় নতুন নির্মিত অংশগুলি ভেঙ্গে ফেলা হবে। তৃতীয়ত তারা আর কখনও দস্তকের অপব্যবহার হবে না।

ওই পলাতক প্রজার গল্পটি বুঝতে গেলে সিরাজের চারপাশের ষড়যন্ত্রের অন্তত একটি খণ্ডচিত্র বুঝতে চেষ্টা করতে হবে যে ষড়যন্ত্রের জাল তার মসনদে বসার অনেক আগে থেকেই বোনা শুরু হয়েছে এবং যা নির্মূল করাই সিরাজের প্রথম ভাবনা ছিল। সিরাজের বড় মাসি ঘসেটি বেগম তার অন্যতম কুশীলব। আলীবর্দির বড় মেয়ে ঘসেটির স্বামী নোয়াজ্জেস মোহম্মদ ছিলেন ঢাকার নায়েব নাজিম তবে সে ঢাকায় থাকত না, তার হয়ে ঢাকার সব কিছু পরিচালনা করত নোয়াজ্জেস ঘনিষ্ঠ হোসেন কুলি খাঁ এবং রাজা রাজদুর্লভ সেন। রাজদুর্লভের হাতে ছিল ঢাকার কোষাগার। সিরাজ যখন মসনদের বসে তখন নোয়াজ্জেস ও হোসেন কুলি খাঁ মৃত এবং রাজদুর্লভ ঘসেটির গুরুত্বপূর্ণ ঘুঁটি। শুধু তাই নয় ঘসেটির মৃত দত্তক পুত্রের নাবালক সন্তানকে সামনে রেখে রাজদুর্লভও চেষ্টায় ছিল ঢাকার শাসন নিজের হাতে তুলে নিতে। সিরাজ তাই নবাব হওয়ার মাস খানেক আগেই, আলীবর্দি তখন মৃত্যুশয্যায়, রাজদুর্লভকে ডেকে কোষাগারের হিসেব চেয়েছিল। আসন্ন পরিস্থিতির কথা আন্দাজ করে ধূর্ত রাজদুর্লভ তার পুত্র কৃষ্ণদাসকে রাজকোষের ধনরত্ন নিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে ইংরেজের আশ্রয় নিতে উপদেশ দেয়। সেই মতো কৃষ্ণদাস তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে পুরীধামে তীর্থযাত্রার নাম করে বেরিয়ে আসে এবং জলপথে কলকাতায় পৌঁছে গভর্নর ড্রেককে প্রচুর ঘুষ দিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামে আস্তানা গাড়ে। সেই সংবাদ পৌঁছয় সিরাজের কাছে।সিরাজ লোক পাঠায় রাজদ্রোহী ফেরত চেয়ে এবং এর সঙ্গে আরও একটি বিশেষ নিষেধাজ্ঞাও ছিল। কারণ ইউরোপে ‘সেভেন ইয়ার্স ওয়ার’ চলতে থাকার অজুহাত দেখিয়ে সেই সময় ফরাসি ও ইংরেজরা দুর্গ সুরক্ষার নামে নবাবী সনদ ছাড়াই তাদের নানা নির্মাণ বাড়িয়ে চলছিল। কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়ামের কাছাকাছি দুটি এবং বাগবাজারে পেরিনস রিডাউটে আরেকটি ব্যাটারি বা তোপমঞ্চ তৈরি করে। কাশীপুরে কেলশাল গার্ডেনের ভিতরে একটা সন্দেহজনক নির্মাণ সম্ভবত গড়বন্দির আয়োজন, সিরাজের গুপ্তচর এই সংবাদও দিয়েছে তাকে। সিরাজ অবিলম্বে এসব কাজ বন্ধ করতে দূত পাঠায়। ফরাসিরা সংযত উত্তর দিলেও ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর রজার ড্রেক আপত্তির তোয়াক্কা না করে উল্টে একটি উদ্ধত চিঠি লেখে যে তারা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য যা দরকার মনে হচ্ছে তাই করছে। কৃষ্ণদাসকে ফেরত দেওয়ার প্রসঙ্গটিও এড়িয়ে যায় তারা। 



ফেরার প্রজা কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দিয়ে আবার যার হুকুমতে আছে তার হুকুমের তোয়াক্কা না করে নিজের চরকায় তেল দাও মার্কা বয়ানে গভর্নর ড্রেকের দুর্বিনীত চিঠিটি ঘৃতাহুতির কাজ করে। দস্তক অর্থাৎ ইংরেজদের দেওয়া শুল্কহীন বাণিজ্য সুবিধার অপব্যবহার জনিত কারণে রাজকোষে ক্ষতি হওয়ার প্রসঙ্গটি আগে থেকেই ছিল। সিরাজ যাচ্ছিল পুর্ণিয়ায় আরেক ষড়যন্ত্রী তার মাসতুত ভাই শওকত জঙ্গকে শায়েস্তা করতে, কিন্তু এই খবর পেয়ে সেই পরিকল্পনা ত্যাগ করে ইংরেজদের আগে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেয়। অতঃপর কলকাতা নগরীর প্রথম যুদ্ধের মঞ্চ প্রস্তুত।

১৬ জুন সিরাজ কাশীপুরের দিক থেকে ৩০ হাজার মতান্তরে ৫০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে শহরে ঢোকে। সংখ্যাধিক্য এবং অতর্কিত আক্রমণই শেষ পর্যন্ত সুবিধে দিয়েছিল তাদের। প্রথম সংঘর্ষ হয় পেরিনস পয়েন্টে। সেখানে ইংরেজদের প্রতিরোধ বলতে ছিল ফ্রান্সিস পিকার্ডের নেতৃত্বে জনা পঁচিশ সেনা যাদের উড়িয়ে দিতে অসুবিধে হত না সিরাজ বাহিনীর। কিন্তু গঙ্গায় নোঙর করে রাখাছিল ভারি তোপ সহ প্রিন্স জর্জ জাহাজ যার অবস্থানের সুবিধা নিয়ে নবাবী সেনাকে বেকায়দায় ফেলতে সমর্থ হয় পিকার্ড। ফলে সেদিন আর না এগিয়ে উমিচাঁদের বাগানবাড়িতে রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নেয় সিরাজ, খাতের পাশে সেনা ছাউনি পড়ে। মারাঠা খাতের কোথায় কোথায় সাঁকো আছে এবং হাতি সহ পেরনো সম্ভব সে খবর সংগ্রহ করতে পাঠানো হয়; গুপ্তচর সে সংবাদ গভীর রাতে পৌঁছে দেয় সিরাজকে। সুতরাং পরের দিন সিরাজ বাহিনী সুতানুটি তছনছ করতে করতে প্রবল প্রতাপে চিৎপুর ধরে এগোতে থাকে।এরপর আবার নবাবদের প্রবল প্রতিরোধের সামনে পড়তে হয় বর্তমানে যেখানে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট ও রবীন্দ্র সরণির সংযোগস্থল ঠিক সেখানে। লেবুম নামে এক ফরাসি সাহেব মাত্র দুটি কামান ও চল্লিশটি মাস্কেট সম্বল করে প্রায় ন’ঘন্টা আটকে রাখতে সমর্থ হয় সিরাজ-মোহনলাল-মীরজাফরদের। লেবুম পর্যুদস্ত হতেই ফোর্ট উইলিয়ামের দোর গোড়ায় পৌঁছে গেল তারা। কেল্লায় তখন বড় জোর আড়াইশ লোক যার অর্ধেকের বেশি অসামরিক। ডাঙার তিন দিক ব্যাটারি দিয়ে সুরক্ষিত করা হলেও একটা মহাসমস্যা ইংরেজদের ডুবিয়েছিল। ফোর্টের ঘাড়ের উপর গির্জা থেকে শুরু করে সমস্ত কেতাদুরস্ত বাড়ির সারি ছিল। গোলা ছুঁড়লে তো সেম সাইড হবেই। সুতরাং পদাতিক সৈন্য দিয়েই প্রতিরোধের নিষ্ফল চেষ্টা হচ্ছিল। অন্যদিকে কথিত নবাবী ফৌজের সামনের সারিতে ছিল চার হাজার পদাতিক এবং সঙ্গে নাগাড়ে গোলা বর্ষণরত চারটি কামান। তাও পূর্ব দিকের ব্যাটারি তাদের আঠেরো পাউন্ডার দিয়ে অনেকক্ষণ চেষ্টা চালিয়েছে প্রতিরক্ষার, যার সামনেই ছিল সেন্ট অ্যান চার্চ যা দুপক্ষের গোলাগুলি খেয়ে অচিরাৎ গুঁড়িয়ে গেল। ১৮ তারিখ সন্ধ্যার পর বাইরে কোন ব্রিটিশ সৈন্য ছিল না বেঁচে, যে কজন ছিল তারা কেল্লায়। তৃতীয় দিন অবস্থা বুঝে দুর্গাধীপ রজার ড্রেক পালানোর জন্য একমাত্র প্রশস্ত যে দিক সেই গঙ্গা দিয়ে জাহাজে করে কিছুসংখ্যক নরনারী সহ চম্পট দেয় এবং ফলতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। কেল্লার দায়িত্ব বর্তায় ম্যাজিস্ট্রেট জন জেফানিয়া হলওয়েলের হাতে। ২০ জুন হলওয়েল সাদা পতাকা দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করে সিরাজ বাহিনীর কাছে। অতঃপর সন্ধ্যায় সিরাজ কেল্লার উত্তরের গেট দিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামে প্রবেশ করে। তারপর ?!

তথ্যসূত্রঃ পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ - রজতকান্ত রায়

ছবিঃ সিরাজ উদ্দৌল্লা - অন্তর্জাল

©প্রজ্ঞা পারমিতা 

 

Comments

  1. ভালো লাগছে পড়তে। সুন্দর বর্ণনা পড়তে পড়তে চোখের উপর ছবির মত ভেসে উঠছে।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ভারতীয় জাদুঘর

বাঙালির নাট্যচর্চা ও রঙ্গমঞ্চ । কলমে - সুতপা দত্ত

অগ্নিযুগের খেলা – আগস্ট বিপ্লব ও একটি বিদ্যায়তন