কালীক্ষেত্র কালীঘাট। কলমে - সঞ্চারী ভট্টাচাৰ্য্য
পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় সতীপীঠ কালীঘাট |অথচ প্রাচীন কোন তন্ত্রগন্থে এর নাম নেই |সতীপীঠ কালীঘাটের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে |পীঠ নির্ণয় তন্ত্রের উনবিংশ পীঠ হল কালীঘাট -
"নকলীশ কালী পীঠে দক্ষ পদাঙ্গুলি চমে,
সর্বসিদ্ধিকারী দেবী কালিকা পত্র দেবতা"|
অর্থাৎ কালীঘাটে সতীর দক্ষিণ পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ব্যতীত চারটি আঙুল পড়েছে, দেবী এখানে কালিকা, ভৈরব নকুলেশ |তবে পীঠমালা তন্ত্রমতে এখানে সতীর বামহস্তের অঙ্গুলি পতনের কথা উল্লেখ আছে -
"সতী দেব্যা শরীরত:
বামভূজাঙ্গুলি পাতো জাতো ভাগীরথী ওঠে"|
নিগমকল্পের পীঠমালায় গঙ্গা তটের ধনুকাকৃতি স্থানকে কালীঘাট বলা হয়| এই গ্রন্থে কালীঘাটকে কাশীর ন্যায় পূণ্যভূমি রূপে নির্দেশ করা হয়েছে|বৃহন্নীল তন্ত্রেও কালীঘাটকে মহাপীঠের আখ্যা দেওয়া হয়েছে| ভারতের সাতজন সিদ্ধ যোগীর একজন লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রথম সাধনা ক্ষেত্র ছিল কালীঘাট| তখন দেবী পর্ণকুটিরে পূজিতা হতেন| আত্মারাম ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মানন্দগিরি মহারাজ দেবীর স্বপ্নাদেশ মত ব্রহ্ম শিলাতে চোখমুখ অঙ্কন করে কালীঘাটেই প্রতিষ্ঠা করেন| দেবী অঙ্গ ব্রহ্ম শিলার নিচের কুঠুরিতে রক্ষিত| তাঁর দর্শন নিষিদ্ধ|
প্রতিবছর স্নানযাত্রার দিন বয়োজ্যেষ্ঠ সেবায়েতরা চোখে কাপড় বেঁধে এই পবিত্র অঙ্গকে মধু ইত্যাদি দিয়ে স্নান করিয়ে পুণরায় যথাস্থানে স্থাপন করেন| মন্দিরের পূর্বদিকে রয়েছে "কালী কুন্ড"|
দেবীর প্রথম মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন যশোরের রাজা বসন্ত রায়| বর্তমান মন্দিরটি 1806 খ্রিস্টাব্দে বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের সন্তোষ রায় কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল| দেবীর যে বিশাল শোনার জিভ সেটি দিয়েছিলেন পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ| কালীঘাটের মা কালী অত্যন্ত জাগ্রতা| ঠাকুর রামকৃষ্ণ, সারদামণি থেকে শুরু করে স্বামী বিবেকানন্দ সকলেই এসেছেন এই মহাতীর্থে|
প্রথম লগ্নে মন্দিরটি হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত ছিল, তবে জলাবদ্ধতা হ্রাস পেয়ে একটি নতুন পথ অবলম্বন করেছে| মন্দিরটি এখন একটি ছোট্ট খালের তীরে দাঁড়িয়ে আছে যা হুগলীর সাথে সংযোগ স্থাপন করে| "চৌরাঙ্গা গিরি" - নামক এক জনৈক সন্ন্যাসী কর্তিক মন্দিরের উপাসনার কাজটি পরিচালিত হয়েছিল এবং বর্তমান "চৌরঙ্গী" অঞ্চলটি তার নামানুসারেই নামকরণ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়|।
কলকাতার বুকে প্রতিষ্ঠিত এই কালী ক্ষেত্রটি বিশ্ববিখ্যাত| হিন্দুদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান হিসেবেও চিহ্নিত| বিশ্বব্যাপী ভক্তদের উপাসনার প্রধান ক্ষেত্র এই কালীঘাট মন্দির| কালীর বিশ্বব্যাপী উপাসকদের প্রার্থনার মূল কান্ডারীরূপে কলকাতার এই ক্ষেত্রটি স্বয়ংসম্পূর্ন মহিমায় বিরাজমান|
কালীঘাট মন্দিরের ইতিহাস প্রায় দু'শো বছরেরও অধিক পুরনো| প্রাচীন ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে কালীঘাট মন্দিরটি নিজের অস্তিত্বকে বলবৎ রেখেছে| এর অনেক চিহ্নই ইঙ্গিত দেয় যে এটি গুপ্ত শাসকদের সাথে জড়িত ছিল| সন্তোষ রায়চৌধুরীর নাতি রাজীব লোচন রায় চৌধুরী কর্তৃক পরবর্তীকালে মন্দিরের কাজ সম্পাদিত হয়েছিল|1809 সালে কালীঘাটের হালদার পরিবারকে মন্দিরের উপাসনার কাজ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং 1960 এর দশকে সুপ্রিম কোর্ট সরকারকর্তৃক মন্দিরের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করা হয়েছিল|
কালীঘাট মন্দিরের কালের দেবতা অনন্য, কারণ এটি অন্যান্য কালী চিত্রের সাধারণ প্যাটার্ন অনুসরণ করে ডিজাইন করা হয়নি| প্রধান বিগ্রহটি তিনটি বিশাল চোখ, চারটি সোনার হাত এবং সর্বাগ্রে লম্বা সোনার জিহ্বা দ্বারা সুসজ্জিত|কথিত আছে এটি সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কুলদেবী মাতা ভুবনেশ্বরীর প্রতিমার উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছিল|
মন্দিরে "জোর-বাংলা"- নামে পরিচিত একটি স্নানঘাট রয়েছে| সীমানা প্রাচীরের বাইরেও একটি পবিত্র জলাশয় রয়েছে যার জল পবিত্র গঙ্গার মতই পবিত্র| এই কুণ্ডটি 'কাকু কুন্ড' - হিসাবে সর্বজনবিদিত| মন্দির প্রাঙ্গণে রাধা-কৃষ্ণকে উৎসর্গীকৃত একটি মন্দির রয়েছে এবং এটিও খুবই জনপ্রিয়| প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে তিনটি পাথর বেষ্টিত একটি বেদী রয়েছে যেখানে প্রতিনিধিত্ব করেন দেবী শশী, শীতলা এবং মঙ্গল চন্ডী| এই পবিত্র স্থানটি 'মনোশা থালা' নামে সুপরিচিত| এই দেবীদের পূজার কাজে নিযুক্ত সমস্ত যাজকেরাই স্ত্রীলোক এবং এখানে কোন খাবার উৎসর্গ করা হয় না| শুধুমাত্র মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে এই দেবীদের আরাধনা করা হয়| তবে এনাদের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য প্রদান করা হয় না|
কথিত আছে,দেবী সতী যখন আত্মত্যাগের আগুনে নিজেকে জীবিত পুড়িয়ে ফেলেন, তখন ভগবান শিব ক্রুদ্ধ হয়ে সতীর দেহকে কাঁধে রেখেছিলেন, তিনি তান্ডব নৃত্য শুরু করেছিলেন। এটি স্বর্গের সমস্ত দেবদেবীদের আতঙ্কিত করেছিল এবং তারা ভগবান বিষ্ণুকে এই বিষয়টি সামলানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তাঁকে শান্ত করতে বিশ্বপালক বিষ্ণু আপন সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে দেন। সতীর খণ্ডবিখণ্ড দেহের টুকরোগুলি পৃথিবীর নানা স্থানে পতিত হয়েছিল। পৃথিবীতে পড়ামাত্রই এগুলি প্রস্তরখণ্ডে পরিণত হয়।পীঠমালা তন্ত্র অনুযায়ী, সতীর ডান পায়ের চারটি আঙুল পড়েছিল কালীঘাটে।
মন্দির চত্বরে অভ্যন্তরের জলাশয়টি গঙ্গার সাথে জড়িত ভূগর্ভস্থ জলাশয় থেকে উদ্ভূত হয়েছিল বলে জানা গেছে| অনেক নিঃসন্তান দম্পতি মায়ের আশীর্বাদ পেতে এই জলাশয়ের জলে স্নান করে পুজো দেন| কালীঘাট ক্ষেত্রটিকে ' কালীর পুরী'- বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে| মন্দিরের ঈশান কোণে প্রায় দু'শ হাত দূরে নকুলেশ্বর ভৈরব বিরাজিত| প্রতিটি শক্তিপীঠই কোনো-না-কোনো ভৈরব দ্বারা সুরক্ষিত থাকে| এই ভৈরব মন্দিরেও আরাধনার জন্য নিযুক্ত রয়েছেন ভৈরব সিদ্ধ তান্ত্রিক ও পুরোহিতরা| বহু তান্ত্রিক ধর্মাচরণের উদ্দেশ্যে এখানে উপস্থিত হন এবং সাধনার ফল লাভের জন্য দেবীর আরাধনায় মত্ত থাকেন|
প্রতিদিনের পুজোর পর মা কালীকে ভোগ নিবেদন করা হয়ে থাকে| ভোগের পর মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ করে দেওয়া হয়| সন্ধ্যার সময় আবার মন্দিরের দরজা খোলা হয় এবং যাত্রীর আধিক্যানুসারে রাত্রে দ্বার বন্ধ করা হয়| সমাগত যাত্রীদের দারাজে অর্থ মায়ের সেবায় নিয়োজিত হয় তা হালদারগণ ও তাঁর দৌহিত্রদের মধ্যে বন্টিত হয়| যে পালাদারের দায়িত্ব যেদিন প্রাপ্ত হয় সেদিন নিয়োজিত অর্থের সমস্তটাই তারা পান| এই অর্থে অন্য কোন পালাদার ভাগ বসাতে পারেন না| বংশ-পরম্পরা অনুযায়ী এই নিয়মই প্রতিপালিত হয়ে আসছে কালীঘাট মন্দিরে|
প্রাত্যহিক পুজো ব্যতীত বাৎসরিক কয়েকটি উৎসবে কালীঘাটে বহু সংখ্যক লোকের সমাগম হয়ে থাকে যথা স্নানযাত্রা, শ্রীরামনবমী, জন্মাষ্টমী, শারদীয় মহোৎসব শ্যামাপূজা প্রভৃতি| এই উৎসবগুলির ব্যয়ভার যদি মা কালীর সাধারণ ভূসম্পত্তি উপস্বত্ব থেকে নির্বাহ করা সম্ভব না হয় তখন সেবায়গন ও তাঁর দৌহিত্রেরা সময়মতো চাঁদা দিয়ে সেই সমুদয়ের ব্যয় নির্বাহ করে থাকেন|
তথ্যসূত্র:-
আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় সংস্করণ, এ. মুখার্জী এন্ড প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা 1985, পৃষ্ঠা 502.
রত্না ভট্টাচার্য, পায়ে পায়ে হাওড়া, পরশপাথর প্রকাশনী, কলকাতা, পৃষ্ঠা 94.
অশোক মিত্র, পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, পৃষ্ঠা 401.
নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস, আদিপর্ব,পৃষ্ঠা 127
কালীক্ষেত্র কালীঘাট, সুমন গুপ্ত, দীপ প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ১৩
"কালীঘাটের কালীমন্দির", বাংলার ঐতিহ্য: কলকাতার অহংকার, পল্লব মিত্র, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ৬৯-৭০
খুব সুন্দর বর্ণনা। একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ। স্বল্প পরিসরেও মহাতীর্থ কালীঘাটের নান্দনিক ও আধিভৌতিক দিকগুলি পরিষ্ফুট হয়েছে। এই সন্দর্ভে প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কালে কালীঘাট মন্দিরের বিবর্তন ইতিহাস পরিষ্ফুট হয়েছে। আমরা লেখিকার কলমে আধুনিক কালীঘাট মন্দিরের রূপকার সন্তোষ রায় মশায়ের কথাও বিস্তারিত জানতে চাই। এই প্রবন্ধ অতি অল্প পরিসরে কালীঘাট ও দেবী কালীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছে। লেখিকার ভাষা অত্যন্ত সুন্দর এবং সাবলীল তাঁর গদ্য। একান্ন সতীপীঠের অন্যতম তীর্থ কালীঘাট মন্দিরের স্বরূপ উন্মোচনে লেখিকার গবেষণাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
ReplyDeleteদারুণ লাগল । সব আবার নতুন করে জানা হল
ReplyDeleteলেখিকার লেখনী এত সুন্দর যে,, কালীঘাটের পূর্ব ইতিহাস পুনরায় অনুরাগীদের সামনে উপস্থাপন করে একটি হ্নদয়র্স্পর্শী পরিবেশ নতুন করে সৃষ্টি করলেন,, লেখিকাকে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো ধৃষ্টতা দেখানোর মতো যথেষ্ট সাহস আমার মধ্যে নেই বলে আমি মনে করি,, আপনি পুনরায় Mythology নিয়ে লেখা শুরু করেছেন দেখে যৎপরনাস্তি আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়লাম,, আমি পূর্বেই আপনার Mythology Article এর খুব বড় অনুরাগীদের মধ্যে একজন,, আপনি এগিয়ে চলুন,, আমরা সর্বদা আপনার সাথে ও পাশে আছি।।
ReplyDeleteভালো থাকবেন,,সুস্থ থাকবেন,,
আর আমাদের উৎসাহিত করতে ভালো ভালো লেখা উপহার দেবেন।। নমস্কার নেবেন।।
~BaBin U Bose~
লেখিকার লেখনী এত সুন্দর যে,, কালীঘাটের পূর্ব ইতিহাস পুনরায় অনুরাগীদের সামনে উপস্থাপন করে একটি হ্নদয়র্স্পর্শী পরিবেশ নতুন করে সৃষ্টি করলেন,, লেখিকাকে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো ধৃষ্টতা দেখানোর মতো যথেষ্ট সাহস আমার মধ্যে নেই বলে আমি মনে করি,, আপনি পুনরায় Mythology নিয়ে লেখা শুরু করেছেন দেখে যৎপরনাস্তি আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়লাম,, আমি পূর্বেই আপনার Mythology Article এর খুব বড় অনুরাগীদের মধ্যে একজন,, আপনি এগিয়ে চলুন,, আমরা সর্বদা আপনার সাথে ও পাশে আছি।।
ReplyDeleteভালো থাকবেন,,সুস্থ থাকবেন,,
আর আমাদের উৎসাহিত করতে ভালো ভালো লেখা উপহার দেবেন।। নমস্কার নেবেন।।
~BaBin U Bose~
সঞ্চারী লেখা পড়ে অনেক তথ্য জানতে পারলাম।
ReplyDeleteমুছে গেল লিখাটা, ভুলবশত, অপূর্ব তথ্য সম্মৃদ্ধ লিখা, তুমি যথেষ্ট অনুসন্ধান চালিয়েছ, তোমার পরিবেশনা অপূর্ব ও সাবলীল ভাষার প্রয়োগ করেছো,
ReplyDeleteপড়ে ভীষণ ভালো লাগল||